শুক্রবার, ৩১ মে, ২০১৯ ০০:০০ টা

আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে বন্ধ্যত্ব

শামীম আহমেদ

আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে বন্ধ্যত্ব

পৃথিবীর অন্যতম নিষ্পাপ ও সুন্দর সৃষ্টি শিশু। বন্ধ্যত্বের অভিশাপে এই শিশুর কোমল স্পর্শ থেকে বঞ্চিত দেশের অগণিত দম্পতি। জন্মহারের লাগাম টানতে নানা প্রচারণার পরও যেখানে প্রতিদিন দেশের জনসংখ্যায় যোগ হচ্ছে প্রায় ছয় হাজার নতুন মুখ, সেখানে এর বিপরীত চিত্রে দেখা যাচ্ছে একটি সন্তানের জন্য অর্ধ কোটির বেশি মানুষের হাহাকার। বিভিন্ন সূত্রের তথ্যমতে, দেশের এখন ৬৭ থেকে ৯৩ লাখ মানুষ সন্তান জন্মদানে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন। বন্ধ্যত্বের এই সমস্যা দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। চিকিৎসকদের ভাষ্য অনুযায়ী, গ্রামের চেয়ে শহরের মানুষের মধ্যে এই সমস্যা অধিক হারে বাড়ছে। এ ছাড়া আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে পুরুষ বন্ধ্যত্বের সমস্যা। এ নিয়ে ফার্টিলিটি সেন্টারগুলোতে (বন্ধ্যত্ব চিকিৎসাকেন্দ্র) প্রতিদিনই রোগীর লাইন বড় হচ্ছে। বিয়ের চার বছর পরও সন্তান না হওয়ায় শ্বশুরবাড়ির গঞ্জনা সইতে না পেরে গত ১৭ মে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন ঢাকার কেরানীগঞ্জ মডেল থানাধীন হযরতপুর ইউনিয়নের জগন্নাথপুর এলাকার আলম মোল্লার স্ত্রী সেলিনা। অথচ পরিবারের কেউ জানত না সন্তান না হওয়ার জন্য দায়ী সেলিনা নাকি তার স্বামী। সন্তান না হওয়ায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ভাঙছে সংসার, ঘটছে আত্মহত্যা বা নারী নির্যাতনের ঘটনা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর দায়ভার নিতে হচ্ছে নারীকে। যদিও চিকিৎসকরা বলছেন, বর্তমানে দেশের বন্ধ্যত্ব সমস্যার অর্ধেকের জন্যই দায়ী পুরুষ। পরিবেশ দূষণ, খাদ্যে রাসায়নিকের মিশ্রণ, জীবনযাপন পদ্ধতিতে পরিবর্তন, ক্যারিয়ারের স্বার্থে দেরিতে বিয়ে ও বিলম্বে বাচ্চা নেওয়ার চিন্তা, ইলেকট্র্রনিক পণ্যের অধিক ব্যবহার, অধিক পরিমাণে প্রক্রিয়াজাত খাবার গ্রহণ, মানসিক চাপ বৃদ্ধি, কর্মস্থলে অধিক গরম ও দূষণ, শরীরচর্চা না করা, ধূমপান ও অ্যালকোহল বন্ধ্যত্ব সমস্যা বাড়িয়ে তুলছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বিশ্বের ১৫ ভাগ দম্পতি বন্ধ্যত্বের শিকার। উন্নয়নশীল দেশের ১৮ কোটির বেশি দম্পতি এ সমস্যায় ভুগছে। ১৯৭৬ সালে সংস্থাটির জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে বন্ধ্যত্ব সমস্যায় ভুগছে ৬ শতাংশ দম্পতি। ১৯৯৬ সালের আরেক গবেষণা প্রতিবেদনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭.১ শতাংশে। চিকিৎসকদের হিসাবে এই হার এখন ১০ থেকে ১৪ শতাংশ। রাজধানীর এ্যাপোলো ফার্টিলিটি সেন্টারের সমন্বয়ক ও চিফ কনসালট্যান্ট ডা. মৃণাল কুমার সরকার বলেন, দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ (৬ কোটি ৭০ লাখ) মানুষ প্রজনন জীবনে আছে। তার মধ্যে ১০-১৪ শতাংশ (প্রায় ৬৭ থেকে ৯৩ লাখ) কোনো না কোনোভাবে সন্তান ধারণে প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করছে। এর মধ্যে প্রায় ৬০ লাখ মানুষের বন্ধ্যত্ব নিরসনে উচ্চতর চিকিৎসা প্রয়োজন। তিনি জানান, এ্যাপোলো ফার্টিলিটি সেন্টারে ২০১১ সালে দৈনিক নতুন রোগী আসতেন ৭-৮ জন, ২০১৯ সালে এসে সেই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে গড়ে ১৫ জনে। এ ছাড়া তখন ১০০ দম্পতির মধ্যে ২০ ভাগ ক্ষেত্রে পুরুষ, ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে নারীসঙ্গী সন্তান না হওয়ার জন্য দায়ী থাকলেও এই হার এখন ৫০-৫০। পুরুষ বন্ধ্যত্বের হার গত ৮ বছরে দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। পুরুষদের মধ্যে শুক্রকিটের অপ্রতুলতা দেখা যাচ্ছে। কারও একেবারেই নেই। ধারণা করা হচ্ছে, পরিবেশ দূষণ ও বিভিন্ন ইলেকট্র্রনিক যন্ত্রের রেডিয়েশনের কারণে এ সমস্যা বাড়ছে। কারণ, চীনে পুরুষ বন্ধ্যত্ব আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। সেখানে দূষণ ও প্রযুক্তির ব্যবহার অনেক বেশি। আয়ের বিবেচনায় বাংলাদেশেও মোবাইল ঘনত্ব অনেক বেশি। এ ছাড়া যাদের কর্মক্ষেত্রে তাপমাত্রা ও দূষণ বেশি তাদের মধ্যে এই সমস্যা বেশি দেখা যাচ্ছে। কায়িক পরিশ্রম কম করা এবং ফাস্টফুড নির্ভর জীবনযাপনের কারণেও অনেকে মুটিয়ে যাচ্ছে। এটা বন্ধ্যত্ব বাড়াচ্ছে- বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে। শহরের মানুষের মধ্যে বন্ধ্যত্ব সমস্যা বেশি পাচ্ছি। এক্ষেত্রে মানসিক চাপ ও জীবনযাপন প্রণালি বড় প্রভাব রাখছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বন্ধ্যত্ব চিকিৎসায় আধুনিক সব ব্যবস্থা আছে। খরচও অন্যান্য দেশের থেকে কম। আইভিএফ (টেস্টটিউব বেবি) খরচ তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা। তবে ৫ ভাগের কম রোগীর এই চিকিৎসা প্রয়োজন হয়। অন্যরা সাধারণ চিকিৎসাতেই ভালো হয়ে যান। তবে বন্ধ্যত্ব চিকিৎসার পরিধি বাড়ানো জরুরি। এই সেবা চালু আছে শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রামে। মোট চাহিদার ৫-৭ ভাগ মেটাতে পারছি আমরা। তাই অনেকে বিদেশ যাচ্ছে। অন্যদিকে মোহাম্মদপুরের ইনফার্টিলিটি কেয়ার অ্যান্ড রিসার্স সেন্টারের (আইসিআরসি) তথ্যমতে, ২০০৫ সালে সেখানে বন্ধ্যত্ব চিকিৎসায় নতুন রোগী আসে ১৮শ’র কিছু বেশি। ২০১৮ সালে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় তিন হাজার ২৪৮ জনে। বন্ধ্যত্ব বিশেষজ্ঞ ও প্রতিষ্ঠানটির চিফ কনসালট্যান্ট অধ্যাপক ডা. রাশিদা বেগম বলেন, এক বছর কোনো জন্মনিরোধক ছাড়া স্বামী-স্ত্রী দাম্পত্য জীবন পার করার পর গর্ভধারণ না করলে বন্ধ্যত্ব বলা হয়। তাদের প্রতিষ্ঠানে বন্ধ্যাত্বর রোগী প্রতিদিনই বাড়ছে। তরুণদের সংখ্যাই বেশি। কম বয়সী রোগীরা চিকিৎসার মাধ্যমে সহজে এ সমস্যা কাটাতে পারলেও, বয়স বেড়ে গেলে চিকিৎসা জটিল হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, অনেকে ক্যারিয়ারের চিন্তায় দেরিতে বিয়ে করছেন। সন্তান নিতে চাইছেন আরও পরে। কর্মের কারণে স্বামী-স্ত্রী আলাদা এলাকায় থাকছেন। তারা সমস্যায় পড়ছেন। আবার কেউ ইচ্ছাকৃত গর্ভপাত ঘটিয়ে পরবর্তীতে আর সন্তানের মুখ দেখতে পারছেন না। ২৫ বছরের পর থেকেই নারীদের সন্তান ধারণক্ষমতা কমতে থাকে। ২৫-২৯ বছর বয়সে প্রজনন সক্ষমতা ৪-৮ শতাংশ এবং ৪৫ বছরের পর ৯২ শতাংশ কমে যায়। তাই ৩০ বছরের আগেই বাচ্চা নেওয়ার চেষ্টা করা উচিত। এ ছাড়া পুরুষের ৪০ বছর পর থেকে শুক্রাণুর মান কমতে থাকে। বয়স ছাড়াও প্রজননতন্ত্রের রোগ ও জন্মগত সমস্যা, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা, পারিবারিক ইতিহাস, প্রজননতন্ত্রে সংক্রমণ, ডায়াবেটিস, স্থূলতা- নানা কারণে বন্ধ্যত্ব দেখা দিতে পারে। খাদ্যদূষণ, পরিবেশদূষণ, প্রক্রিয়াজাত খাবার বেশি খাওয়া, মোবাইলের মতো ইলেকট্র্রনিক পণ্যের বেশি ব্যবহার, ফাস্টফুড নির্ভরতা, দেরিতে বিয়ে ও সন্তান নিতে চাওয়া, অধিক সঙ্গীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন, সচেতনতার অভাবে প্রজননতন্ত্রের যত্ন না নেওয়া, অপরিচ্ছন্ন থাকা, ধূমপান, অ্যালকোহল, শরীরচর্চা না করা- নানা কারণে বন্ধ্যত্ব বাড়ছে। সচেতনতা ও পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনের মাধ্যমে এই সমস্যা অনেকটাই এড়ানো যায়। বিয়ের পরপরই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। স্কুলে এ ব্যাপারে বিস্তারিত শিক্ষা দেওয়া দরকার। তিনি বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চিকিৎসায় সফলতা আসে। তবে ৩০ বছরের কম বয়সী নারীর ক্ষেত্রে সফলতার হার ৫০ ভাগের  বেশি। বয়স ৪০ হয়ে গেলে সফলতা ১০ ভাগ।

সর্বশেষ খবর