রবিবার, ২ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

ভয়াবহ তারল্য সংকটে লিজিং কোম্পানি

গ্রাহকের অর্থ দিতে পারছে না ঠিকভাবে, নতুন করে পাচ্ছে না আমানতও

আলী রিয়াজ

ভয়াবহ তারল্য সংকটে লিজিং কোম্পানি

মূলধন নেই, আমানত নেই, তারল্য সংকটে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়েছে দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা লিজিং কোম্পানিগুলো। গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠানগুলো এখন চরম পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো নিজেদের আর্থিক সংকটে বিনিয়োগকারীদের মুনাফা পর্যন্ত দিতে পারছে না। আমানত সংগ্রহের ক্ষেত্রে কোথাও টাকা পাচ্ছে না। নগদ অর্থের মূল উৎস হিসেবে ব্যাংকগুলো থেকে গত কয়েক বছর ধরেই কোনো টাকা পাচ্ছে না প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে প্রতিদিনের চাহিদা প্রধান ভরসা হয়ে উঠছে কলমানি মার্কেট। তবে ব্যাংকগুলোতেও আর্থিক ঘাটতি থাকায় লিজিং কোম্পানিগুলো চাহিদা মতো অর্থ পাচ্ছে না। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান চলছে খুঁড়িয়ে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির কারণে ইমেজ সংকটে পড়েছে লিজিং কোম্পানিগুলো। এখন কেউ আর টাকা রাখতে ভরসা পাচ্ছে না লিজিং খাতে। জানা গেছে, বেশ কয়েকটি লিজিং কোম্পানির পরিচালকরা নামে-বেনামে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। ফলে এ খাতে খেলাপি লিজিংয়ের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এখন বিনিয়োগ করা টাকা ফেরত আসছে না। ব্যাংকে তারল্য সংকটের কারণে ব্যাংকগুলোও লিজিং  কোম্পানিগুলোকে অর্থ দিচ্ছে না। অন্য কোনো উৎস্য থেকেও তারা তহবিলের জোগান পাচ্ছে না। সব মিলিয়ে আর্থিক সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। কয়েকটি কোম্পানির কারণে পুরো খাতের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরিস্থিতি উত্তরণের জন্য একাধিকবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে উদ্যোগ  নেওয়া হয়েছে। তবে দুই বছর ধরে এই খাতের কোনো উন্নতি হয়নি।

জানা গেছে, লিজিং কোম্পানিগুলো সঞ্চয়কারীদের কাছ থেকে ব্যাংকের মতো সহজে আমানত নিতে পারে না। তাদের আমানত নেওয়ার ক্ষেত্রে  বেশকিছু শর্ত আছে। এর মধ্যে তিন মাসের কম  মেয়াদি কোনো আমানত নিতে পারে না। তবে এর  বেশি মেয়াদি আমানত নিতে পারে। ব্যাংকগুলো চলতি আমানতসহ যে কোনো মেয়াদি আমানত নিতে পারে। এ ছাড়া তারা নিজেরা সরাসরি আমানতের টাকা পরিশোধ করতে পারে না।  লেনদেন করতে হয় ব্যাংকের মাধ্যমে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিলের বড় উৎস হচ্ছে ব্যাংক। এদের কাছ থেকে তারা স্থায়ী আমানত ও কলমানি থেকে অর্থ নেয়। প্রায় সব ব্যাংকেরই স্থায়ী আমানত রয়েছে লিজিং কোম্পানিগুলোতে। এর বাইরে সামান্য কিছু আমানত আসে সঞ্চয়কারীদের মধ্যে থেকে। বর্তমানে তাদের মোট তহবিলের মধ্যে আমানত থেকে আসে ৬০ শতাংশ। এখন আমানতের বড় অংশই হচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে চড়া সুদে নেওয়া  মেয়াদি আমানত। কোম্পানির মূলধন থেকে আসে ১৫ শতাংশ আমানত। কিন্তু কোম্পানিগুলোর  খেলাপি লিজের হার বেড়ে যাওয়ার কারণে মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। কলমানি মার্কেটে ধার করা  থেকে আসে ২০ শতাংশের। বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট চলছে। সরকারি খাতের চারটি বাণিজ্যিক ব্যাংক ও বেসরকারি খাতের কয়েকটি ইসলামী ব্যাংক ছাড়া প্রায় সব ব্যাংকেই রয়েছে তারল্য সংকট। যে কারণে ব্যাংকগুলোও এখন লিজিং কোম্পানিতে আমানত রাখতে পারছে না। উল্টো স্থায়ী আমানত হিসেবে লিজিং কোম্পানিতে রাখা আমানতের অংশ তুলে নিচ্ছে ব্যাংক। কলমানি মার্কেট থেকেও তারা ধার পাচ্ছে না। কেননা কয়েকটি লিজিং কোম্পানি কলমানি থেকে একদিনের জন্য ধার করে তা পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে তার মেয়াদ বাড়াতে হচ্ছে। এতে ব্যাংকও বিপাকে পড়েছে। এসব কারণে কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বড় ধরনের তহবিল সংকটে পড়েছে। আর্থিক সংকটে তাদের যেমন লিজ কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে।  তেমনি গ্রাহকদের কাছ থেকে নেওয়া আমানতের টাকাও পরিশোধ করতে পারছে না। সংকটের কারণে এ বছর নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে গেলেও ৬টি লিজিং কোম্পানি ২০১৮ সালের লভ্যাংশ ঘোষণাই করতে পারেনি। প্রতিষ্ঠানগুলো পর্ষদ সভাও করেনি। ডিসেম্বর ক্লোজিং লিজিং  কোম্পানিগুলোর ২০১৮ সালের আর্থিক হিসাব ও লভ্যাংশ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সময় নির্ধারিত। তবে  সেই সময় পার হয়ে গেলেও এখনো ৬টি লিজিং  কোম্পানির আর্থিক হিসাব প্রকাশ করা হয়নি। প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়েই এখন উদ্বিগ্ন বিনিয়োগকারীরা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, লিজিং কোম্পানির কয়েকটির পরিস্থিতি খুবই শোচনীয়। এগুলো এখন চলতে পারছে না। প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনায় যারা রয়েছেন তাদের দুর্নীতি একটি বড় কারণ। এ ছাড়া ব্যাংকের শ্রেণীকৃত ঋণ বেশি ও তারল্য সংকট রয়েছে। ফলে লিজিং কোম্পানিগুলো আমানতের মূল উৎস ব্যাংক থেকে কোনো অর্থ পাচ্ছে না। খেলাপি ঋণ কমে না এসে উত্তরণ সহজে হবে না।

লিজিং কোম্পানি আইডিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সার্বিক ব্যাংকিং সংকটের প্রভাবের কারণে লিজিং কোম্পানিগুলো কিছুটা সংকটে পড়েছে। ৫/৬টি লিজিং কোম্পানির পরিস্থিতি অনেকটাই খারাপ। কয়েকটির খেলাপির পরিমাণ ২০ শতাংশও রয়েছে। তারা ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে সব নিয়মকানুন মানেনি। ফলে খুবই সংকটের মধ্যে পড়েছে। তবে সব লিজিং কোম্পানি যে খারাপ পরিস্থিতিতে আছে সেটাও সঠিক নয়। আমাদের আইডিএলসির খেলাপি দুই শতাংশের একটু বেশি। যা কোনো ঝুঁকিতে নেই।

সর্বশেষ খবর