মঙ্গলবার, ৪ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

ছাত্রদলের নেতৃত্বে আসতে বয়স্করা আগ্রহী, সার্চ কমিটি চায় নবীন

মাহমুদ আজহার

সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ২৫৯টি পদের বিপরীতে বিএনপি সমর্থিত ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল প্রার্থী দিতে পেরেছিল মাত্র ৫৮টিতে। এর মধ্যেও ১৫ জন প্রার্থী বিভিন্নভাবে ধার করা। প্রতিটি পদেই শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে ছাত্রদলের প্রার্র্থীদের। এমনকি ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান মাত্র ২৪৫টি ভোট পেয়েছেন। এ নিয়ে বিব্রত বিএনপির হাইকমান্ড। এর পরই ছাত্রদল পুনর্গঠনের দাবি ওঠে সব মহল থেকে। এরই ধারাবাহিকতায় মেয়াদোত্তীর্ণ ছাত্রদলের কমিটি দিতে সাবেক ছাত্রনেতাদের সমন্বয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একটি ‘সার্চ কমিটি’ গঠন করে দেন। তারা এ নিয়ে কাজও করেন। তারা তারেক রহমানের কাছে সুপারিশ করেন, ডাকসুর আদলে নেতৃত্বের বয়স ২৯ বছরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা। কিন্তু এতে বাধা হয়ে দাঁড়ান বর্তমান ছাত্রদলের ‘বুড়ো’ নেতারা, যাদের বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশোর্ধ্ব। তারা এখনো ছাত্রদলের নেতৃত্বে রয়েছেন। কমিটিতে থাকার পক্ষে তারা নানা যুক্তিও তুলে ধরেন। ২০১৪ সালের অক্টোবরে রাজীব আহসানকে সভাপতি ও আকরামুল হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রদলের কমিটি ঘোষণা করেছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। দুই বছর মেয়াদি এই কমিটির মেয়াদ শেষ হয় ২০১৬ সালের অক্টোবরে। ফলে গত আড়াই বছরেরও বেশি সময় ধরে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে চলছে ছাত্রদলের কার্যক্রম। নতুন কমিটি গঠনের লক্ষ্যে গত মার্চ মাসে ছাত্রদলের কমিটি করতে সাবেক ছাত্রনেতাদের দিয়ে একটি সার্চ কমিটি করে দেন তারেক রহমান।

সার্চ কমিটির নেতারা হলেন- শামসুজ্জামান দুদু, ড. আসাদুজ্জামান রিপন, আমানউল্লাহ আমান, রুহুল কবির রিজভী, ফজলুল হক মিলন, খায়রুল কবির খোকন, নাজিম উদ্দিন আলম, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, হাবিব-উন-নবী খান সোহেল, এ বি এম মোশাররফ হোসেন, আজিজুল বারী হেলাল, শফিউল বারী বাবু, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, আমিরুল ইসলাম খান আলিম, আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল, হাবিবুর রশীদ হাবিব, বর্তমান ছাত্রদলের সভাপতি রাজিব আহসান ও সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান। গত কয়েক মাসে সার্চ কমিটির নেতারা নিজেদের মধ্যে ছাড়াও তারেক রহমানের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছেন। কিন্তু তারা এখন পর্যন্ত ছাত্রদলের কমিটি নিয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি। তবে সার্চ কমিটির নেতারা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানিয়েছেন, তারা একটি সুপারিশমালা তারেক রহমানকে দিয়েছেন। সেখানে ছাত্রদলের নেতৃত্বের বয়স ২৯ থেকে ৩০ রাখা হয়েছে। অবশ্য বিকল্প প্রস্তাবে বয়স্ক নেতৃত্বের কথাও তুলে ধরা হয়েছে। জানা যায়, শুক্রবার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে দুই শতাধিক নেতা একত্র হয়ে এ নিয়ে স্কাইপিতে তারেক রহমানের সঙ্গে কথা বলেন। বেলা ৩টা থেকে ইফতার-পূর্ব পর্যন্ত এই মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। তাদের সবার দাবি-সংবলিত একটি লিখিত বক্তব্যও তারেক রহমানকে পড়ে শোনানো হয়। তারেক রহমান সবার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে সবাই এক সুরে বলেন, ‘আমাদের দাবিগুলো ওই লিখিত বক্তব্যে আছে। এর বাইরে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই।’ পরে সবার সম্মতিক্রমে ছাত্রদলের বর্তমান কমিটির এক নম্বর সহ-সভাপতি এজমল হোসেন পাইলট লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন। এ সময় তারেক রহমান লিখিত বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে কিছু প্রশ্নও করেন। তিনি কিছু জবাব দেন। আবার ছাত্রদলের আরেক সহ-সভাপতি নাজমুল হাসানও কিছু প্রশ্নের জবাব দেন। এ ছাড়া ছাত্রদলের সভাপতি রাজিব আহসান ও সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান বক্তব্য দেন। তাদের সবার বক্তব্যেই বয়স্কদের নেতৃত্বে আরও অন্তত দুটি কমিটি করার প্রতি জোর সুপারিশ করা হয়। এ সময় তারেক রহমান বয়স্কদের পক্ষে-বিপক্ষে কমিটি দেওয়ার যুক্তিও ছাত্রনেতাদের কাছে জানতে চান। একপর্যায়ে তারেক রহমান বলেন, ‘আপনাদের বক্তব্য আমি সার্চ কমিটির সঙ্গে আলোচনা করব।’ তারেক রহমান হতাশার সুরে এও বলেন, ‘৭৩৬ সদস্যের কমিটির প্রায় সাড়ে ৩০০ নেতাই নিষ্ক্রিয়। এত বড় ঢাউস কমিটি করেও কোনো লাভ হয়নি।’ স্কাইপিতে তারেক রহমানের কাছে লিখিত বক্তব্যে ছাত্রদলের পাইলট বলেন, ‘পরোক্ষভাবে জানতে পেরেছি, দলীয় হাইকমান্ড নিয়মিত ছাত্রদের দিয়ে ছাত্রদলের শীর্ষ নেতৃত্ব নির্বাচন করতে চায়। আমরা বিনয়ের সঙ্গে জানাতে চাই, আপনার যে কোনো সিদ্ধান্তই আমাদের শিরোধার্য। কিন্তু চলমান বাস্তবতায় এ মুহূর্তে এ ধরনের সিদ্ধান্ত দলের জন্য আত্মঘাতী হতে পারে। একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণও হতে পারে।’

লিখিত বক্তব্যে তিনটি দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিগুলো হলো- ‘প্রথমত, বয়সের সুনির্দিষ্ট সীমারেখা না রেখে ছাত্রদলের কমিটি গঠনের চিরাচরিত ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে একটি ধারাবাহিক কমিটি আগামী বছরের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত গঠন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, পরবর্তী সময়ে স্বল্পমেয়াদি একটি ধারাবাহিক কমিটি গঠন করতে হবে। তাহলে সংগঠন গতিশীল হবে। তৃতীয়ত, বর্তমান কেন্দ্রীয় সংসদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়, মহানগর ও কলেজ কমিটির সমন্বয়ে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হলে সংগঠন আরও গতিশীল হবে।’ চিঠির অনুলিপি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও সার্চ কমিটির প্রধান সাবেক ছাত্রনেতা শামসুজ্জামান দুদুকেও দেওয়া হয়। ছাত্রদলের নেতারা বলছেন, ঈদের পরপরই ছাত্রদলের যে কোনো ফরম্যাটে কমিটি ঘোষণা হতে পারে। তবে ছয় মাসের জন্য বয়স্ক নেতাদের নেতৃত্বে একটি আহ্বায়ক কমিটি দেওয়া হতে পারে। এরপর ১ জানুয়ারি ২৯-৩০ বছরের নেতাদের নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি হওয়ার আভাস পাওয়া গেছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতারা বলছেন, কমিটি যে ফরম্যাটেই করা হোক না কেন, এ ক্ষেত্রে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাধান্য দিলে হবে না, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কেও গুরুত্ব দিতে হবে। নইলে কমিটির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। কেন অনিয়মিত ছাত্রদের দিয়ে ছাত্রদলের কমিটি চান তারা- জানতে চাইলে এজমল হোসেন পাইলট বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বর্তমান কমিটির মেয়াদ পাঁচ বছর হয়েছে। নিয়মিতভাবে কমিটি হলে এই সময়ে আমরা আরও দুটি কমিটি পেতাম। কিন্তু বাস্তবতার কারণে সেটি হয়নি। এখন যদি শুধু ‘‘নিয়মিত’’ ছাত্রদের দিয়ে কমিটি হয়, তাহলে বর্তমান কমিটির নেতারা কোথায় যাবেন? তারা কোথায় রাজনীতি করবেন? তাই আমরা আগামী কমিটিতেও বয়সের সুনির্দিষ্ট সীমারেখা না রাখতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে অনুরোধ করেছি।’ ছাত্রদলের আরেক সহ-সভাপতি নাজমুল হাসান বলেন, ‘কোনো বাড়ির মালিক ভাড়াটিয়াকে উচ্ছেদ করতেও তিন মাসের সময় বেঁধে দেন। হুট করে ছাত্রদলের কমিটির নেতৃত্বের বয়স ২৯ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ হলে ৫-৭ লাখ নেতা বাদ পড়ে যাবেন। এতে তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বেন। এর প্রভাব পড়বে বিএনপিতেও। তাই ছয় মাস মেয়াদি একটি কমিটি এবং আগামী ১ জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এক বছর মেয়াদি একটি কমিটির পর ছাত্রনেতৃত্ব ২৯ বছরে সীমাবদ্ধ করা হলে কোনো সমস্যা হবে না।’ এ প্রসঙ্গে সার্চ কমিটির প্রধান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘আমরা সার্চ কমিটির নেতারা কয়েকটি বৈঠক করে আলোচনা করেছি। আমরা তারেক রহমানের সঙ্গে সংগঠনের ভালো-মন্দ দিক নিয়েও আলোচনা করেছি। ছাত্রদলের নেতৃত্বে ছাত্ররাই থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। এখন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সিদ্ধান্ত দেবেন।’ ‘অনিয়মিত’ ছাত্রদের দিয়ে ছাত্রদলের কমিটি গঠন করার দাবি প্রসঙ্গে শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘তারা তাদের দাবি তুলে ধরেছেন। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সবকিছু বিবেচনা করে এখন সিদ্ধান্ত দেবেন তারেক রহমান।’

ভেঙে দেওয়া হলো ছাত্রদলের কমিটি : নতুন কমিটি গঠনে বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের বর্তমান কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। গতকাল রাতে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে ছাত্রদলের রাজীব আহসান ও আকরামুল হাসান নেতৃত্বাধীন কমিটি বিলুপ্তির কথা জানানো হয়। খবর বিডিনিউজ। এতে বলা হয়, আগামী ৪৫ দিনের মধ্যে সংগঠনটির কাউন্সিলরদের মতামতের ভিত্তিতে নতুন কেন্দ্রীয় সংসদ গঠন করা হবে। ছাত্রদলের কাউন্সিলে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে। এগুলো হচ্ছে- ১. প্রার্থীদের জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্রাথমিক সদস্য হতে হবে;

২. অবশ্যই বাংলাদেশের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হতে হবে; ৩. ২০০০ সালের পরে এসএসসি/সমমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। কাউন্সিলের তফসিল পরে জানানো হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। ছাত্রদলের সর্বশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছিল ২০১৪ সালের ১৪ অক্টোবর। রাজীব আহসানকে সভাপতি ও আকরামুল হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত ওই আংশিক কমিটিতে তখন ১৫৩ সদস্য ছিলেন। দীর্ঘদিন পর কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হয়, যাতে ৭৩৬ জনকে পদ দেওয়া হয়।

সর্বশেষ খবর