শনিবার, ৮ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গাদের চাপে বিপর্যস্ত স্থানীয় জনজীবন

ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার চিন্তা

শিমুল মাহমুদ, কক্সবাজার থেকে ফিরে

মিয়ানমারের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর চাপে বিপর্যস্ত স্থানীয় জনজীবন। নতুন ও পুরনো মিলিয়ে স্থানীয় মানুষের দ্বিগুণের চেয়েও বেশি রোহিঙ্গা স্থানীয়দের কর্মক্ষেত্র, হাটবাজার, কৃষিজমি, পরিবেশ, আয় রোজগার, এমনকি নিরাপত্তায় ভাগ বসিয়েছে। স্থানীয়দের আয় রোজগার কমে গেছে। তাদের জীবিকার পথ রুদ্ধ হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয়দেরও রোহিঙ্গাদের সমপরিমাণ সহায়তা দেওয়ার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছে সরকার। এক সময় মানবিক কারণে স্থানীয়রা রোহিঙ্গাদের সাহায্যার্থে হাত বাড়িয়েছিলেন, তারাই এখন রোহিঙ্গাদের ‘আপদ’ মনে করছেন। সম্প্রতি কক্সবাজার সদর ও উখিয়ার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে স্থানীয় মানুষের এখন আর কোনো সহানুভূতিই নেই। নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থে কক্সবাজারের মানুষ রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে ক্ষোভ ও নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করছেন। উখিয়ার স্কুল শিক্ষক গোলাম মোস্তফা বললেন, রোহিঙ্গারা এখন স্থানীয়দের সবকিছুতে ভাগ বসিয়েছে। তারা আমাদের লোকজনের কাজের জায়গাও দখল করে ফেলেছে। রোহিঙ্গারা সস্তায় কাজ করায় স্থানীয় শ্রমজীবীদের কাজের অভাব দেখা দিয়েছে। এতে স্থানীয় শ্রমজীবীদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, যে কাজে আগে ৫০০ টাকা মজুরি পাওয়া যেত, তা রোহিঙ্গারা করে দিচ্ছে ২০০ টাকায়। ওরা সরকার থেকে ফ্রি খাবার পায়, রেশন পায়। এ জন্য তারা নগদ যা পায় তাই লাভ। কিন্তু এ কারণে আমাদের পেটে তো লাথি পড়ছে। রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয় কৃষিজীবী মানুষের আয় কমে গেছে, অন্যদিকে বেড়ে গেছে জীবনযাত্রার ব্যয়। বাজারে বেড়ে গেছে জিনিসপত্রের দাম। দ্বিগুণ দামে কিনতে হচ্ছে মাছ, মাংস, শাক, সবজি। রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি বানাতে গিয়ে মাইলের পর মাইল পাহাড়কাটা, জ্বালানির জন্য বন উজাড়, আসবাবের জন্য বড় বড় গাছগুলো কাটার কারণে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হতে চলেছে। ইতিমধ্যেই গরম বেড়ে গেছে রোহিঙ্গা শিবির এলাকায়। কমে গেছে বৃষ্টিপাত।

রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়রা নানা হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। স্থানীয়দের এলাকায় চলাফেরা করতে গিয়ে নিজেদেরকে ‘রোহিঙ্গা নয়’ সে পরিচয় প্রমাণ দেখাতে হয়। এটি তাদের জন্য পীড়নের কারণ হয়েছে। এক স্থানীয় ব্যবসায়ী জানান, এখানে (উখিয়া) ন্যাশনাল আইডি এবং জন্মনিবন্ধন সনদ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, রোহিঙ্গারা ভুয়া কার্ড করে বাংলাদেশিদের মধ্যে ঢুকে পড়তে পারে এই ভয়ে। ওরা টাকা খরচ করে পাসপোর্ট পর্যন্ত করে ফেলছে।

রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয় জনগোষ্ঠী সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছে, অনেকের চাষের জমি পর্যন্ত দখল হয়ে গেছে। রোহিঙ্গারা স্থানীয়দের জীবনযাত্রাকেও তছনছ করে দিচ্ছে। উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গফুর উদ্দীন চৌধুরী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রোহিঙ্গাদের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়েছে উখিয়া ও টেকনাফ। তাদের জন্য স্থানীয়দের জীবন কঠিন এবং দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। তারা নানা অপরাধ কর্মকা  ঘটাচ্ছে। ফলে স্থানীয়রা পড়েছে চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে। আমরা আছি ৬ লাখ মানুষ আর ওরা ১০ লাখ, ওরাই তো বেশি। বোঝেন কেমন আতঙ্কে আছি। তারা সামান্য কারণেই স্থানীয়দের ওপর মারমুখী আচরণ করে। দুটি ভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতির মানুষ এক জায়গায় থাকার কারণে উখিয়া ও টেকনাফে মনস্তাত্ত্বিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে বসে খাওয়ার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি স্থানীয়দের কাজের অভাবে না-খেয়ে থাকার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ায় নিজেদের বঞ্চিত ভাবছেন স্থানীয়রা। স্থানীয় হাসপাতালে রোহিঙ্গারা অগ্রাধিকার পাওয়ায় স্থানীয়দের চিকিৎসাসেবা পেতেও দুর্ভোগ হচ্ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, স্থানীয়দের সহায়তার বিষয়ে আমরা চিন্তাভাবনা করছি। আন্তর্জাতিক সব সংস্থার সঙ্গে সরকারের একাধিক বৈঠক হয়েছে। তাদের বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের যে পরিমাণ সহায়তা দেবে, স্থানীয়দেরও তার সমপরিমাণ সহায়তা দিতে হবে। এ শর্তে তারা রাজি হয়েছেন।

সর্বশেষ খবর