স্বাধীনভাবে কিছু করা, নিজের পায়ে দাঁড়ানো, নিজের টাকায় বিভিন্ন স্বাদ-আহ্লাদ পূরণের ইচ্ছা জেবার মধ্যে কাজ করত স্কুলজীবন থেকেই। সেই স্বপ্নে গতি সঞ্চার করে সংবাদপত্রে অনলাইনে উপার্জনবিষয়ক একটি ফিচার প্রতিবেদন। বদলে যায় জেবার দিনের সব রুটিন। সহপাঠীরা যখন আড্ডায় ব্যস্ত, জেবা তখন ব্যস্ত ইন্টারনেটে বিভিন্ন টিউটোরিয়াল আর আর্টিক্যাল ঘাঁটাঘাঁটিতে। ফল পেতে সময় লাগেনি। ২০১৭ সালে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর করার পর চট্টগ্রামের মেয়ে জেবা ইসলাম ২০১১ সালে ইন্টারনেট থেকে প্রথম উপার্জনের টাকা হাতে পান। তিন দিনে আয় করেন ৩৫ ডলার। বর্তমান সময়ের হিসাবে প্রায় তিন হাজার টাকা। এখন জেবার মাসিক আয় বাংলাদেশের প্রথম সারির যে কোনো চাকুরের চেয়ে কম নয়। ঘরে বসেই কাজ করেন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য। সঙ্গে চালিয়ে গেছেন পড়াশোনা। আইন নিয়ে উচ্চশিক্ষা শেষ করলেও ফ্রিল্যান্সিংকে বিদায় জানাতে চান না জেবা। ইদানীং অনলাইনে ই-কমার্সও শুরু করেছেন তিনি। চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর করা জেবা ইসলামের বাড়ি চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ এলাকার হাজিপাড়ায়। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে জেবা দ্বিতীয়। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমরা বাড়িতে পত্রিকা পড়ি। নিয়মিত খবরে দেখতাম শিক্ষাজীবন শেষে দেশের লাখো তরুণ-তরুণী বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে হতাশায় দিন পার করছেন। মাঝেমধ্যে আত্মহত্যার ঘটনাও দেখতাম। কোন বিষয়ে লেখাপড়া করলে বেকার থাকতে হবে না তা নিয়ে সারাক্ষণ ভাবতাম। বিভিন্নজনের সঙ্গে আলাপ করে আইন বিষয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিই। এর মধ্যেই সংবাদপত্রে “অনলাইনে উপার্জন” নিয়ে একটি প্রতিবেদন আমাকে এ বিষয়ে উৎসাহিত করে। একটা কম্পিউটার, ইন্টারনেট সংযোগ আর কাজ জানা থাকলে ঘরে বসেই লাখ টাকা উপার্জন সম্ভব। এরপর ইন্টারনেটে এ নিয়ে বিভিন্ন আর্টিক্যাল পড়তে থাকি। ইউটিউবে নানা ভিডিও টিউটোরিয়াল দেখি। তখন ২০১০ সাল। টিউটোরিয়াল দেখে কিছু কাজ শিখে অনলাইন মার্কেট প্লেসে বিড করতে শুরু করি। ২০১১ সালে এসে অডেক্সে ৩৫ ডলারের একটি লিঙ্ক বিল্ডিংয়ের কাজ পাই। সেই শুরু। এখন আমার বেশ কয়েকটি নির্দিষ্ট ক্লায়েন্ট আছে। যাদের লিড জেনারেশন ও আউটরিচের কাজটা আমি দীর্ঘদিন ধরে করছি। ২০১২ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানির সঙ্গে কাজ করছি। দৈনিক ৫-৬ ঘণ্টা কাজ করি। এ ছাড়া ফ্রিল্যান্সিংয়ের পাশাপাশি আমি ছোট করে ফেসবুক পেজভিত্তিক ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করেছি। আমার পেজের নাম “শিন এন শাইন”। সব মিলে অনলাইনকেন্দ্রিক আমার মাসিক আয় বাংলাদেশের যে কোনো প্রথম সারির চাকরির চেয়ে কম নয়। কাজে স্বাধীনতাও আছে। তবে এ ক্ষেত্রে ধৈর্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। লেগে থাকলে আর কাজ জানলে সফলতা আসবেই। তবে কেউ এক বছরেই ভালো অবস্থানে চলে যায়, কারও চার-পাঁচ বছরও লেগে যায়। শুরুর দিকে আয় কম থাকলেও দক্ষতা ও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আয় বাড়তে থাকে।’ জেবা বলেন, ‘ফ্রিল্যান্সিংয়ে ভালো করতে ধৈর্যের পাশাপাশি ইংরেজি জানা ও কাজে দক্ষ হওয়াটা খুব জরুরি। আপনি ভালো কাজ জানেন কিন্তু ইংরেজি জানেন না, তাহলে যোগাযোগ করে কাজ নিতে পারবেন না। আবার ইংরেজি জানেন কিন্তু ভালো কাজ জানেন না, তাহলে শুরুতে যোগাযোগ করে একটা-দুইটা কাজ জোগাড় করতে পারলেও ভবিষ্যতে এই পথ চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। এটা বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সব ফ্রিল্যান্সারের জন্যও ক্ষতিকর। অনেকেই ভালো করে কাজ না শিখে এই সেক্টরটার ক্ষতি করছে। এ কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান এখন বাংলাদেশিদের কাজ দিতে চায় না। দিলেও মজুরি কম দেয়। অবশ্য এর মধ্যেও অনেকে ভালো রোজগার করছে। কেউ তো মাসে ১০ লাখ টাকার বেশিও উপার্জন করছে।’ তিনি বলেন, ‘ফ্রিল্যান্সিংয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে প্রতিনিয়ত নিজেকে আপডেট করতে হয়। কারণ প্রতিযোগী বিশ্বব্যাপী। শুরুতে গুগল ও ইউটিউব আমার শিক্ষক হলেও পরে অনলাইন/অফলাইন দুইভাবেই বিভিন্ন কোর্স করেছি। ভিডিও কোর্স কিনেছি। নতুন নতুন কাজ শিখেছি। ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, গুগল এডসেন্স, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ডিজিটাল পেইড মার্কেটিং এবং এফিলিয়েট মার্কেটিং কোর্স করেছি। কিছু ছিল দু-তিন দিনের ওয়ার্কশপ, কিছু তিন মাসের শর্ট কোর্স।’ ঘরে বসে ৫০ হাজার টাকা রোজগার করতে কী করতে হবে? এমন প্রশ্নে জেবা বলেন, ‘কেউ ঘণ্টায় ১০ ডলার করে চার্জ করলে তাকে ৭০ ঘণ্টার মতো কাজ করতে হবে। আর কেউ ২৫ ডলার প্রতি ঘণ্টায় চার্জ করলে ২৮ ঘণ্টার মতো কাজ করতে হবে। আপনি কতটা যোগ্য তার ওপর নির্ভর করছে ক্লায়েন্ট আপনাকে প্রতি ঘণ্টার জন্য কত দেবে। নতুনরা সাধারণত ৩ থেকে ১০ ডলার রেটে কাজ করে। আবার বাংলাদেশের অনেকে প্রতি ঘণ্টার জন্য ২৫ ডলারের বেশিও পায়। এ ছাড়া কাজের ধরনের ওপরও রেটনির্ভর করে। গ্রাফিক্স, মার্কেটিং, প্রোগ্রামিং, ওয়েব ডিজাইনের প্রচুর কাজ মার্কেটে। রেটও মোটামুটি ভালো। এ খাতে আবার ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যাও বেশি। ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, অ্যাপস ডেভেলপন্টের চাহিদা এখন ভালো।’ ক্যারিয়ার নিয়ে স্বপ্নের কথা জানাতে গিয়ে জেবা বলেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয়ের জন্য আইন পেশায় থাকব। তবে আমার মূল লক্ষ্য অনলাইন পেশা। এখন ফ্রিল্যান্সিং করছি। সামনে নিজের ফ্যাশন, ক্লোথিং আর বিউটি প্রোডাক্ট নিয়ে ই-কমার্স ব্যবসা তৈরি আমার বর্তমান স্বপ্ন।’