রবিবার, ৯ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

কুরিয়ারে সব পাঠানো সম্ভব, সাবধান!

সাখাওয়াত কাওসার

কুরিয়ারে সব পাঠানো সম্ভব, সাবধান!

২০১৮ সালের ২২ ডিসেম্বর পোস্টাল অধিদফতরের কনফারেন্স কক্ষে এক কর্মশালায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মো. রাজী হাসান তার বক্তব্যে একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলছিলেন, ডাম বিস্ফোরক সংবলিত একটি পার্সেল দেশীয় নামকরা কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পাঠিয়ে আবার অন্য একটি প্যাকেটের মাধ্যমে পুনরায় ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। হরহামেশাই ঘটছে এমন ঘটনা। ওই কর্মশালায় উপস্থিত কুরিয়ার সার্ভিস মালিকদের কয়েকটি সংগঠনের প্রতিনিধিরা কোনো উত্তর দিতে পারেননি। নীরবতার মাধ্যমেই তারা কুরিয়ার সার্ভিসগুলোতে বিরাজমান নাজুক নিরাপত্তাব্যবস্থার চিত্র স্বীকার করে নিয়েছিলেন।

১৯ মে বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিস এস এ পরিবহনের উত্তরার অফিস থেকে এক লাখ পিস ইয়াবার প্যাকেটসহ দুজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-৩-এর একটি দল। ঝিনুকের অলঙ্কারের নামে ওই প্যাকেটটি আনা হয়েছিল কক্সবাজার থেকে। পরে এ ঘটনায় ওই কুরিয়ার সার্ভিসের তিন কর্মকর্তাকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেয় র‌্যাব। তবে মামলায় কুরিয়ার সার্ভিসের অজ্ঞাত চারজনের নাম উল্লেখ করা হয়। এর পর থেকে আবার কুরিয়ার সার্ভিসের নিরাপত্তার বিষয়টি উঠে আসে।

এ তো গেল মাত্র দুটি ঘটনা। অভিযোগ রয়েছে, কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে হরহামেশাই ঘটছে অস্ত্র, মাদক ও আমদানি-নিষিদ্ধ বিভিন্ন পণ্য পরিবহনের মতো ঘটনা। বিশেষ করে বহুল আলোচিত হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলায় ব্যবহৃত অত্যাধুনিক অস্ত্রগুলো সীমান্তবর্তী জেলা থেকে আমের ঝুড়িতে করে আনা হয়েছিল বলে তদন্তে উঠে এসেছে। সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক কয়েক দফায় গণমাধ্যমকর্মীদের এ কথাটি বলেছিলেন। এর পরও টনক নড়েনি কর্তৃপক্ষের। কোনো ধরনের স্ক্যানিং ছাড়াই চলছে পণ্য পরিবহনের কার্যক্রম। এর বাইরেও বিপুল পরিমাণ অর্থিক লেনদেনের ঘটনা ঘটলেও ওই সব প্রতিষ্ঠানের ওপর কোনো নজরদারি নেই। সরকার বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকে। এ বিষয়ে ইন্টারপোল কয়েক দফা সতর্কবার্তাও পাঠিয়েছে পুলিশ সদর দফতরে। অন্যদিকে শতাধিক লাইসেন্সবিহীন কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দেশে-বিদেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। তবে এ ধরনের ৫৩টি লাইসেন্সবিহীন প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি করে ডাক লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়া হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

অপরাধ-বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থ ও পণ্য পরিবহনের সঙ্গে জড়িত কুরিয়ার সার্ভিসের ওপর কড়া নজরদারি দরকার। দরকার যুগোপযোগী আইন। নয় তো একদিন রাষ্ট্রকেই এর খেসারত দিতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানকে অপব্যবহার করে বড় ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে অপরাধীরা। সর্বশেষ ২০১৩ সালের বিধিমালাও কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণের জন্য যুগোপযোগী হয়নি বলে মন্তব্য করেন তারা। পণ্য পরিবহন এবং অর্থ লেনদেনের মতো কার্যক্রম পরিচালনা করলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো নিয়ন্ত্রণ কিংবা তদারকি নেই এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের প্রধান ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মো. রাজী হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে অনেক পণ্যের পাশাপাশি অর্থ লেনদেনও হচ্ছে। তাদের অর্থ লেনদেনের ওপর নজরদারি এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য কর্তৃপক্ষের উদ্যোগের বিরুদ্ধে রিট করেন কুরিয়ার সার্ভিসের মালিকরা। যদিও পরে ওই রিট খারিজ হয়ে যায়। এখন সময় এসেছে এ ব্যাপারে আবারও উদ্যোগ নেওয়ার। কে কার কাছে টাকা কিংবা কী পণ্য পাঠাচ্ছে এ বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য সংরক্ষণ করা দরকার। অপরাধমূলক কর্মকা- ঠেকাতে এটা অত্যন্ত জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।

জানা গেছে, বাংলাদেশে গত প্রায় ৩০ বছর ধরে কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবসা চলে এলেও এখন পর্যন্ত এ-সংক্রান্ত যুগোপযোগী কোনো আইন প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি। শত বছরের পুরনো পোস্টাল আইন (১৮৯৮) দিয়েই চলছে কুরিয়ার সার্ভিস। যদিও ২০১১ সালে সরকার এ বিধিমালার কয়েকটি ধারা সংশোধন করে কুরিয়ার সার্ভিস বিধিমালা তৈরি করে। কিন্তু কয়েকজন ব্যবসায়ী ওই বিধিমালার বিরুদ্ধে আদালতে রিট করলে তাও স্থগিত হয়ে যায়। পরে হাই কোর্ট কিছু বিষয়ে শিথিলতা দেখানোর কথা বললে সর্বশেষ ২০১৩ সালে মেইলিং অপারেটর ও কুরিয়ার সার্ভিস বিধিমালা পাস হয়। তবে এই বিধিমালার দুর্বলতার বিষয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। ২০১৩ সালের বিধিমালায় লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের শর্তভঙ্গ কিংবা অপরাধের জন্য কোনো কুরিয়ার সার্ভিস কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল করার ক্ষমতার বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি। কেবল অর্থিক দ- এবং লাইসেন্স স্থগিত করার ক্ষমতার বিষয়টি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। আবার বিধিমালায় লাইসেন্স প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কুরিয়ার সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হওয়ার শর্ত দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে কুরিয়ার লাইসেন্সিং কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানের অর্গানোগ্রাম নিয়ে কাজ চলছে। আমাদের জনবলের খুব সংকট। এর মধ্যেও বিধিমালার আরও কিছু বিষয় নিয়ে আমরা পর্যালোচনা করছি। কারণ নিরাপত্তা একটা বড় বিষয়।’

আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও স্কাইলাইন কুরিয়ার সার্ভিসের স্বত্বাধিকারী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আসলে দেশে-বিদেশে গত কয়েক বছরের ঘটনায় আমরাও উদ্বিগ্ন। এ কারণে যে কোনো পার্সেলের যথাযথ তল্লাশির প্রয়োজন। আমদানি-রপ্তানির পণ্যগুলো বিমানবন্দরে যথাযথ তল্লাশির মাধ্যমেই হস্তগত হয়। শিগগিরই বিমানবন্দরের কাস্টম হাউসে শুধু কুরিয়ার সার্ভিসের জন্য আলাদা স্ক্যানিং মেশিন বসানো হচ্ছে।

তবে কুরিয়ার সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি হাফিজুর রহমান পুলক বলেন, কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে কিছু অসাধু ব্যক্তি অপরাধমূলক কর্মকা- করছে এটা সত্য। তবে তার নিজের প্রতিষ্ঠানের শাখাগুলোতে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো আছে। তার সংগঠনের সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর শাখাগুলোতে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানোর নিদের্শনা রয়েছে। একই সঙ্গে তারা বুকিং অফিসারদের সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বলে তিনি জানান।

২০১৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জ এসএ পরিবহন কুরিয়ার সার্ভিসের অফিস থেকে দুটি বিদেশি পিস্তল, চারটি ম্যাগাজিন ও ২৪ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যরা, যা নোয়াখালী পাঠানোর জন্য বুকিং দেওয়া হয়েছিল। ২০১৪ সালের ৩১ জানুয়ারি সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের বেনাপোল শাখা থেকে একটি বিদেশি পিস্তল ও ১৫৩ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। একই বছর ১৭ জুন লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্ট একটি শার্টের পার্সেলের ভিতর থেকে আধা কেজি হেরোইন উদ্ধার করে। ২০১৩ সালে জুতার সোলের ভিতর যুক্তরাজ্যের হেরোইন পাচারের ঘটনা ধরা পড়ে। ওই সময় গ্রেফতার তুহিন জানিয়েছিলেন, তিনি ডিএইচএল ও অ্যারামেক্সসহ বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামে অবস্থিত তার খালাতো ভাই শাহ আলমের কাছে হেরোইন পাচার করতেন। ২০১৫ সালে মে মাসে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ২০ লাখ টাকা মূল্যের ৭৫ কেজি ওষুধ জব্দ করে কাস্টমস গোয়েন্দারা। আমদানি নীতিমালা ভঙ্গ করে এসব ওষুধ ডিএইচএল কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ‘হেল অ্যান্ড হার্টি’ নামে ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানের জন্য ভারত থেকে আনা হয়েছিল।

কুরিয়ার সার্ভিসে করে অবৈধ মালামাল পরিবহন প্রসঙ্গে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ‘সম্প্রতি র‌্যাব এসএ পরিবহন থেকে এক লাখ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে। এতে কুরিয়ারের গাফিলতির বিষয়টি স্পষ্ট। আমরা আমাদের গোয়েন্দা কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি। কুরিয়ার সার্ভিসগুলো নীতিমালা অনুযায়ী চলছে কি না তা দেখার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ রয়েছে।’ ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উপকমিশনার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, যেভাবে কুরিয়ার সার্ভিস চলছে, এর মাধ্যমে মরণঘাতী বিস্ফোরক পাঠানোও সম্ভব। চোরাচালান আর অস্ত্র ব্যবসার একটি নিরাপদ বাহন কুরিয়ার সার্ভিস। উচ্চ আদালতের মাধ্যমে তারা তাদের পণ্য রাস্তায় চেক করা যাবে না- এমন নির্দেশনা আদায় করেছে। শুধু একটি স্ক্যানার মেশিন ব্যবহার করে কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানগুলো সহজেই এ-সংক্রান্ত অপরাধ অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিন্তু তারা তা করছে না।

সর্বশেষ খবর