রবিবার, ৯ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

আশ্রয় কেন্দ্র ও শিশুপল্লীতে অন্য রকম ঈদ

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্

আশ্রয় কেন্দ্র ও শিশুপল্লীতে অন্য রকম ঈদ

গাজীপুরে বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে প্রতিবছরের মতো এবারও স্বজনহীনভাবে অনেকটা চোখের জলে এক ধরনের নিরানন্দ ঈদ উদযাপন করেন সেখানকার আশ্রিতরা। বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা দুই শতাধিক বয়স্ক বাবা-মা সকাল থেকে স্বজনদের অপেক্ষায় থাকলেও দেখা পাননি প্রিয় স্বজনদের। তবু থেমে থাকেনি আশ্রিত এসব মা-বাবার ঈদ। আশ্রিত বাবা-মায়েরা নিজেদের মধ্যেই ভাগ করে নেন ঈদ আনন্দ। আশাভঙ্গের যন্ত্রণা আর হারানো দিনের সুখস্মৃতি বয়ে বেড়ানো বাবা-মা তারা। সন্তানরা ভুলে গেলেও ভোলেন না তারা। বৃদ্ধাশ্রম থেকে দেওয়া নতুন জামা পরে সেমাই-পিঠা, গোস্ত-পোলাও খেয়ে ঈদের দিনটি অন্যরকমভাবে কাটিয়ে দেন। অপরদিকে শিশুপল্লী প্লাসে আশ্রিত শিশু ও মায়েরাও উদযাপন করেছেন অন্যরকম ঈদ। তিন দিনব্যাপী ঈদ আনন্দে মেতে ওঠেন আশ্রিত এসব শিশু ও মা।

নামাজের পর আশ্রয়কেন্দ্রে খিচুড়ি দিয়ে হয় সকালের নাস্তা। দুপুরে খেতে দেওয়া হয় পোলাও, গরু ও মুরগির গোশত। দুপুরের খাবারের পর দইও দেওয়া হয়। পবিত্র ঈদ উপলক্ষে আশ্রিত পুরুষদের নতুন পাঞ্জাবি, ফতুয়া, লুঙ্গি এবং মহিলাদের নতুন শাড়ি, থ্রি-পিস দেওয়া হয় আশ্রয়কেন্দ্রের পক্ষ থেকে। ঈদের নামাজ, সকালের নাস্তা, দুপুরে ভালো-মন্দ খাবার, নতুন জামা- এসবের মধ্য দিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা বয়স্করা আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন। তবে সাময়িক এই আনন্দের মধ্যে চোখে-মুখে অনেকটা হতাশার ছাপও দেখা যায়। টলমল চোখে তাকিয়ে থাকেন- এই বুঝি বাড়ি থেকে কোনো স্বজন এলো একটু সঙ্গ দিতে। কিংবা বাড়ি থেকে প্রিয় সেই খাবার নিয়ে এলো। ঈদের দিন সকাল থেকেই এই আশ্রিতরা অপেক্ষা করেন সন্তান-সন্ততি বা নিকটাত্মীয় কেউ এসে দেখা করবেন। কিছু সময় পাশে থাকবেন। কিন্তু আশা-নিরাশার মধ্য দিয়েই উৎসব আনন্দের ঈদের দিনটি কাটিয়ে দিতে হলো এসব অবহেলিত বৃদ্ধ বাবা-মাকে।

কথা হয় আশ্রিত বৃদ্ধ মা-বাবার সঙ্গে। লিটন মিয়া (ছদ্মনাম) নামের আশি বছরের এক বৃদ্ধ। বাড়ি নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার চরতাতারদি গ্রামে। তিন সন্তানের জনক। ঈদের দিন সকালে সেমাই মুখে দিতেই চোখের অশ্রু ঝরে। মনে পড়ে তার সেই সুখের দিনগুলোর কথা। তিনি সুখের দিনগুলোর কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। বলেন, ‘একটি এনজিওতে চাকরি করতাম। কোনোমতে দুঃখ-কষ্টের মধ্যে সংসার চালাতাম। দুই ছেলে ও এক মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করি। এখন আমি বয়স্ক হয়ে যাওয়ায় আমার সন্তানরা আমাকে পর করে দিল। রেখে গেল এই বৃদ্ধাশ্রমে। তবে এখানে কষ্টের মধ্যেও আনন্দেই আছি। কষ্ট শুধু বৃদ্ধ বয়সে নাতি-নাতনিদের নিয়ে আনন্দ করা হলো না।’ আশ্রয়কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক আবু শরীফ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, এখানে থাকা বয়স্কদের বিনা খরচে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। এখানে ১৫ জন হিন্দু এবং ৩ জন খ্রিস্টান রয়েছেন। ভিন্ন ধর্মের লোকের ধর্ম-কর্ম নিজস্বভাবে পালনের সুযোগ রয়েছে। এ বছর বাড়িতে ঈদ করতে যান ৩২ জন বৃদ্ধ বাবা-মা। অন্যদিকে অসহায় অবহেলিত শিশু ও মা’দের পুনর্বাসনে গড়ে উঠেছে শিশুপল্লী প্লাস নামে একটি আশ্রয়কেন্দ্র। শিশুপল্লীর প্রতিষ্ঠাতা পেট্টিসিয়া কার ও পুনর্বাসিত-আশ্রিতদের উপস্থিতিতে এবারের ঈদ যেন এক মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে। আর এই আশ্রিতদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগ করে নেন নব্য নাগরিকত্ব পাওয়া পেট্টিসিয়া কার। আশ্রিত এসব শিশুকে নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মসজিদেই ঈদের নামাজ আদায় করেন। নামাজের পর আশ্রিত শিশুদের নিয়ে শিশুপল্লীর সদস্যরা সকালে সেমাই, পিঠা, পায়েস দিয়ে নাস্তা করেন। পরে ভাত আর সাধারণ তরকারি দিয়ে দুপুরের খাবার খায় আশ্রিত শিশুরা। রাতে দেওয়া হয় গোশত-পোলাওসহ বিশেষ খাবার। এতে থাকে গরু, খাসি ও মুরগির গোশত। পাশাপাশি সবজি, ডাল ও নানা ধরনের পিঠা-পায়েসও থাকে রাতের খাবারে। তিন দিনব্যাপী আয়োজনের মধ্যে ঈদের আগের দিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত আশ্রিত শিশু ও মা’দের জন্য বিভিন্ন ইভেন্টের খেলা ও মিউজিকবিষয়ক নানা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। পরে ওই দিন সন্ধ্যায় শুরু হয় মেহেদি উৎসব। যে যেভাবে খুশি মেহেদি দিয়ে হাত রাঙায়। ঈদের দিন রাতে শিশুপল্লীর প্রতিষ্ঠাতা পেট্টিসিয়া কার আশ্রিত মা ও শিশুদের সঙ্গে রাতের খাবার গ্রহণ করেন। ঈদের পরদিন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে শিশুদের জন্য নাচ, গান, ছড়া উৎসব ও মায়েদের জন্য নাচ-গানের আয়োজন করা হয়। সন্ধ্যায় তিন দিনের অনুষ্ঠানে বিজয়ী ও সব অংশগ্রহণকারীকে পুরস্কৃত করা হয়। ওই দিন সন্ধ্যায় সিনেমাও দেখানো হয়। শিশুপল্লী প্লাসের চেয়ারম্যান সৈয়দ শামসুল আলম চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, একজন ব্রিটিশ নাগরিক পেট্টিসিয়া কার শিশুপল্লী প্লাস আশ্রয়কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি শিশুদের সঙ্গে ঈদের মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে ভালোবাসেন। পেট্টিসিয়া কারকে বাংলাদেশ সরকার নাগরিকত্ব দেয়। এতে তিনি অনেক খুশি।

সর্বশেষ খবর