সোমবার, ১০ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

মামলা নিষ্পত্তি সাড়ে ৫ শতাংশ

মানব পাচারের অভিযোগে ছয় বছরে আটক ৬ হাজার, সাজা ২৫ জনের, ৭ বছরেও গঠন হয়নি ট্রাইব্যুনাল

মাহবুব মমতাজী

মানব পাচারের ঘটনায় গত ৭ বছরে মামলা হয়েছে ৪ হাজার  ৪৪৬টি। এর মধ্যে মাত্র ২৪৭টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এতে সাজা হয়েছে ২৫ জনের। এ তথ্য পুলিশ সদর দফতরের। তবে মানব পাচার রোধে কাজ করা সংস্থাগুলো বলছে, আইন থাকলেও কার্যকর প্রয়োগের অভাবে মানব পাচারে জড়িতদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।

পুলিশ সদর দফতরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৭ বছরে মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশ মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। মানব পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে গত ৬ বছরে আটক হয়েছে ৬ হাজার ১০৬ জন। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে করা মামলাগুলো বছরের পর বছর ধরে বিচারাধীন অবস্থায় পড়ে আছে। এদের বিচার নিশ্চিত করতে না পারায় দুই বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের মানব পাচার প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে টায়ার-২ ওয়াচ লিস্টে (দ্বিতীয় স্তরের নজরদারি) রাখা হয়েছে। যদিও পাচার ঠেকাতে ২০১২ সালে মানব পাচার দমন ও প্রতিরোধ আইন করে সরকার। কিন্তু এ আইনের অধীনে ট্রাইব্যুনাল গঠনের কথা থাকলেও গত ৭ বছরে তা হয়নি। ট্রাইব্যুনাল গঠন না হওয়ায় আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুসারে প্রতিটি জেলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মানব পাচারের মামলার বিচার চলছে। এতে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হচ্ছে বলে মনে করছেন এ খাতের বিশেষজ্ঞরা।

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু বলেন, অনেক সময়ই পিপিরা মানব পাচার মামলার শুনানিতে আগ্রহ কম দেখান। সাক্ষী হাজির করতেও তারা গাফিলতি করেন। এ কারণে একদিকে যেমন বিচারে  দীর্ঘসূত্রতা হয়, তেমনি আসল অপরাধীরা পার পেয়ে যায়।

জানা গেছে, নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালকে মানব পাচার মামলা নিষ্পত্তির এখতিয়ার দেওয়া হলেও ট্রাইব্যুনালগুলোকে অনেক সময় সব ধরনের মামলা নিষ্পত্তিতে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। এই মুহূর্তে ৬৪ জেলায় ৪ হাজার ১৭৭টি মামলার মধ্যে ৩০৪টি মামলা পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন। এর মধ্যে ঢাকায় পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন মামলা রয়েছে ৪৮টি, মানিকগঞ্জে ৬টি, নরসিংদীতে ১৯৮টি, জয়পুরহাটে ১টি, খুলনায় ৫টি, যশোরে ২৭টি, সাতক্ষীরায় ৫টি, চুয়াডাঙ্গায় ১টি, নড়াইলে ৫টি, মেহেরপুরে ১টি, বরগুনায় ৪টি এবং সিলেটে ৩টি মামলা পাঁচ বছর ধরে বিচারাধীন রয়েছে।  হাই কোর্টের সাবেক বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার এ বি এম আলতাফ হোসেন বলেন, মানব পাচার মামলায় সাজা কম হওয়ার পেছনে পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনগুলো বিশেষভাবে দায়ী। দেখা যায়, একটি মামলার পর এফআইআরএ যেসব তথ্য থাকে চূড়ান্ত প্রতিবেদনে গিয়ে অনেক তথ্যই পরিবর্তন হয়ে যায়। যার পেছনে তদন্ত কর্মকর্তার প্রভাবিত হওয়ার বিষয় থাকে। মামলার বিচার শুরুর পর আবার সাক্ষীদের সঠিকভাবে হাজির করতে পারে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। ফলে আসামিদের যথাযথ সাজা দিতে পারেন না বিচারকরা। মানব পাচারের ঘটনায় জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করতে মনিটরিং বাড়াতে হবে। এদিকে জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী, বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৮ লাখ নারী ও শিশু পাচারের শিকার হয়। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ পাচারের শিকার হয় যৌনবৃত্তির জন্য। পাচারের ক্ষেত্র হিসেবে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপাল সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া আছে মিয়ানমার। দক্ষিণ এশিয়ায় বছরে দেড় লাখ মানুষ পাচারের শিকার হয়। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার তথ্যে, গত ৮ বছরে প্রায় দেড় লাখ মানুষ বঙ্গোপসাগর দিয়ে মানব পাচারের শিকার হয়েছে। ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে অন্তত দেড় হাজার মানুষ মারা গেছে। পাচারের শিকার ব্যক্তিদের বড় একটি অংশকে আটকে মুক্তিপণ আদায় করে একটি চক্র। ২০১৫ সালে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডের গণকবর থেকে উদ্ধার করা হয় পাচারের শিকার দুই শতাধিক ব্যক্তির লাশ। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ দফতরের ২০১৬ সালের গ্লোবাল রিপোর্ট অনুযায়ী, পাচারের শিকার মানুষগুলোর মধ্যে ৫১ শতাংশ নারী, ২১ শতাংশ পুরুষ, ২০ শতাংশ কিশোরী এবং ৮ শতাংশ কিশোর। এর মধ্যে ৪৫ শতাংশই পাচার হয় যৌনকাজের জন্য এবং ৩৮ শতাংশকে শ্রমের জন্য। ইউরোপীয় কমিশনের পরিসংখ্যান দফতর ইউরোস্ট্যাটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত এক লাখের বেশি বাংলাদেশি ইউরোপের দেশগুলোতে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সূত্র জানায়, গত পাঁচ বছরে ১৬টি মামলার দ াদেশ হয়েছে, এর মধ্যে সাজা হয়েছে ৩১ জনের। ১৩৭টি মামলায় খালাস পেয়েছে ৪৩৪ জন। মোট ১৫৩টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে।

সর্বশেষ খবর