সোমবার, ১০ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

সেবার মাশুল বাড়াতে চায় চট্টগ্রাম বন্দর, ব্যবসায়ীদের আপত্তি

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

বে-টার্মিনাল, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল, কর্ণফুলী কনটেইনার টার্মিনাল, লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনালসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণের অর্থ সংস্থান করতে চট্টগ্রাম বন্দরের সেবার মাশুল (ট্যারিফ) বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক)। তবে ব্যবসায়ীরা এ ধরনের উদ্যোগের বিরোধিতা করে বলছেন, এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যয় আরও বেড়ে যাবে।

সূত্রগুলো জানান, চট্টগ্রাম বন্দরের সেবার মাশুল বাড়াতে গত ৩১ মার্চ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে সভা হয়। ওই সভায় চবকের প্রতিনিধিরা বিভিন্ন সেবার মাশুল বাড়ানোর যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। সভায় জানানো হয়, চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে যে মাশুল আদায় হচ্ছে, তা নির্ধারণ করা হয় ১৯৮৬ সালে। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ায় এখন ট্যারিফ রেট হালনাগাদ করা প্রয়োজন। তবে ব্যবসায়ীরা এ নিয়ে আপত্তি জানালে ট্যারিফ বাড়ানোর প্রস্তাবটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য এ-সংক্রান্ত কমিটির কাছে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।

সম্প্রতি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ওই সভার কার্যবিবরণী থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ট্যারিফের বিষয়ে কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, ‘পরামর্শক নিয়োগের মাধ্যমে বিদ্যমান ট্যারিফ হালনাগাদ করার বিষয়টি সময়সাপেক্ষ হওয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে অত্যাবশ্যকীয় ও জরুরি বিবেচনায় বিদ্যমান ট্যারিফের কিছু আইটেমের রেট বৃদ্ধি বা হালনাগাদের বিষয়টি কমিটির পরবর্তী সভায় পর্যালোচনা করা হবে।’ সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানান, সভায় বন্দর ব্যবহারে ১৫টি সেবার বিপরীতে অন্তত ৬০টি উপখাতে মাশুল ৩৩ থেকে ৪৮৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করে চবক। এ ছাড়া নতুনভাবে আরও ৫টি আইটেমের ওপর ফি আরোপেরও প্রস্তাব দেওয়া হয়। যেসব খাতে মাশুল বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয় সেগুলো হচ্ছে : পোর্ট ডিউজ, পাইলটেজ ফি, বার্থিং-আনবার্থিং ফি, বার্থে অবস্থান, মুরিংয়ে অবস্থান, পানি সরবরাহ চার্জ, রিভার ডিউজ (প্রথাগত) ও ল্যান্ডিং অথবা শিপিং চার্জ (প্রথাগত), বন্দরের স্থান ব্যবহার ভাড়া (স্পেস রেন্ট), কনটেইনার বোঝাই ও খালাসকরণ, রিফার কনটেইনার সেবা, রিভার ডিউজ (কনটেনারাইজড), লিফট অন/লিফট অফ চার্জ (চট্টগ্রাম বন্দর), লিফট অন/লিফট অফ চার্জ (ঢাকা আইসিডি) এবং ঢাকার আইসিডিতে কনটেইনারের স্টোরেজ ভাড়া। সূত্রগুলো জানান, পাইলটেজের আওতাধীন নাইট নেভিগেশনের ফি থেকে সবচেয়ে বেশি মাশুল বাড়াতে চাইছে চবক। তিন ক্যাটাগরিতে ৪৪০ দশমিক ৫৪ শতাংশ থেকে ৪৮৮ দশমিক ২৪ শতাংশ ফি বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে তারা। এ ছাড়া নাইট নেভিগেশন ফি হিসেবে ৫ হাজার জিআরটির (গ্রোস রেজিস্টার্ড টনেজ) নিচের জাহাজের জন্য ১৮ দশমিক ৫০ মার্কিন ডলারের মাশুল বাড়িয়ে ১০০ ডলারে উন্নীত করতে চাইছে তারা। ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার জিআরটির জাহাজের ক্ষেত্রে ৩৪ ডলার থেকে বাড়িয়ে ২০০ ডলার এবং ১০ হাজারের বেশি জিআরটি জাহাজে ৪৩ ডলারের স্থলে ২৫০ ডলার করতে চায় চবক। পাইলটেজের ফি প্রতি ১ হাজার জিআরটি জাহাজের ক্ষেত্রে ৩৫ দশমিক ৭৫ ডলার থেকে বাড়িয়ে ৫০ ডলার, আর জাহাজ এক বার্থ থেকে অন্য বার্থে নেওয়া কিংবা ঘোরানোর ফি ২৯ দশমিক ৮০ ডলার থেকে বাড়িয়ে ১০০ ডলার (২৩৫ শতাংশ) করতে চায়। এ ছাড়া নতুন যে ৫টি আইটেমে ফি আরোপের প্রস্তাব করা হয়, তার মধ্যে হ্যাচ কভার হ্যান্ডলিং চার্জ ১১৪ ডলার, মোবাইল হারবার ক্রেন ব্যবহার করে ২০ হাজার কেজি পণ্য ওঠানো-নামানো চার্জ ৭ ডলার ও ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার কেজি পর্যন্ত ওঠানো-নামানো ১০ ডলার প্রস্তাব করে চবক। এ ছাড়া প্রতি ঘণ্টা হারবার ক্রেন ভাড়া ১০০ ডলার করা হয়েছে। খালি কনটেইনার অপসারণ ২১ ফুট পর্যন্ত ১০ ডলার ও ২১ ফুটের বেশি দৈর্ঘ্যরে কনটেইনারে ২০ ডলার ও মোবাইল স্ক্যানার চার্জ কনটেইনারভেদে ৮ থেকে ১০ ডলার প্রস্তাব করে চবক। সভায় বন্দর কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিরা মাশুল বাড়ানোর যৌক্তিকতা দিয়ে বলেছেন, বন্দরের অবকাঠামো সুবিধা বাড়াতে বে-টার্মিনাল, পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল, কর্ণফুলী কনটেইনার টার্মিনাল, লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল ইত্যাদির নির্মাণকাজ বাস্তবায়নে অনেক অর্থের প্রয়োজন হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ট্যারিফ বৃদ্ধি করে বন্দরের আয় বাড়ানোর বিকল্প নেই। এ ছাড়া তারা বন্দরের পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধির কথাও তুলে ধরেছেন। মাশুল বাড়ানোর যৌক্তিকতা তুলে ধরে চবকের প্রস্তাবে বলা হয়, ২০১১-১২ থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জাহাজ ও কার্গো খাতের আয়ের প্রবৃদ্ধির গড় আনুমানিক ৭ শতাংশ। পক্ষান্তরে অপারেশনাল খরচের গড় প্রবৃদ্ধির হার আনুমানিক ১২ শতাংশ। ওই সময়ে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের গড় প্রবৃদ্ধি আনুমানিক ১৩-১৪ শতাংশ। অর্থাৎ আয় ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং প্রবৃদ্ধির চেয়ে অপারেশনাল খরচ বৃদ্ধির হার তুলনামূলক বেশি। চবকের প্রধান অর্থ ও হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান বিদ্যমান ট্যারিফ হালনাগাদ করার ব্যাপারে মতামত ও যৌক্তিকতা তুলে ধরে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যারিফ হালনাগাদ করার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের উদ্দেশ্যে ইতিমধ্যে রিকোয়েস্ট ফর এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট (ইওআই) জারি করা হয়েছে। বর্তমানে আগ্রহী পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের তালিকা সংক্ষিপ্তকরণের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বন্দরের ট্যারিফ হালনাগাদ করা অত্যন্ত জরুরি।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইএবি)-এর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বন্দরের ট্যারিফ বাড়ানোর জন্য চবক যেসব কথা বলেছে তার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তারা বলেছে বেশ কয়েক বছর আগে এসব ট্যারিফ নির্ধারিত হয়েছে, এখন হালনাগাদ করা প্রয়োজন। তারা অপারেশনাল কার্যক্রম বৃদ্ধির কথা তুলে ধরেছে। আমাদের বক্তব্য হলো, অপারেশনাল কার্যক্রম বাড়ার কারণে তাদের আয়ও কিন্তু বেড়েছে। আগের চেয়ে কনটেইনার হ্যান্ডলিং অনেক বেড়েছে। এ থেকে তাদের মুনাফাও বেড়েছে। তারা ট্যারিফ বাড়ানোর আগে অন্যান্য আন্তর্জাতিক বন্দরের ট্যারিফ রেট দেখুক। সেখানে ফি কমছে। চবকের উচিত দক্ষতা বাড়িয়ে বরং সেবার মাশুল আরও কমিয়ে দেওয়া। তারা তা না করে উল্টো বাড়াতে চাইছে।’ বন্দরের ফি বাড়লে এটি ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যয় আরও বাড়িয়ে দেবে বলে মন্তব্য করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।

সর্বশেষ খবর