সোমবার, ১৭ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

লেবাননে শ্রম বাজারে দালালদের দৌরাত্ম্য

শিমুল মাহমুদ, বৈরুত (লেবানন) থেকে

লেবাননের শ্রমবাজারে দালালদের দৌরাত্ম্যের কারণে জাতিসংঘের মেরিটাইম টাস্কফোর্সের আওতায় নিয়োজিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর শান্তিরক্ষীদের সব অর্জন ম্লান হয়ে যাচ্ছে। গত নয় বছরে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা দুঃসাহসিক অভিযান ও কর্তব্যনিষ্ঠার কারণে লেবাননের সরকার ও জনগণের কাছে অত্যন্ত মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। কিন্তু লেবাননের শ্রমবাজারে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দালালদের সম্পৃক্ততার কারণে বঞ্চিত হচ্ছে শ্রমিকরা। তাদের কষ্টার্জিত শ্রমের টাকায় ভাগ বসাচ্ছে দালালরা। ভিসা বিক্রি, আকামা হস্তান্তরসহ কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করার অভিযোগ প্রচুর। রাজনৈতিক পরিচয়ের ছত্রছায়ায় বাংলাদেশি দালালরা অনৈতিক ফায়দা তুলছে। দালালের খপ্পরে পড়ে অবৈধ হয়ে যাওয়া শ্রমিকদের একটা বড় অংশ কোনো বেতন-ভাতা ছাড়াই অমানবিক জীবনযাপন করছেন বিভিন্ন মার্কেটে, শপিংমলে ক্রেতাদের ব্যাগ রাখা, ব্যাগ গুছিয়ে দেওয়াসহ অনির্ধারিত নানা কাজে জড়িয়ে কোনোমতে জীবিকানির্বাহ করছেন। গত কয়েক দিনে লেবাননের রাজধানী বৈরুতসহ বিভিন্ন শহরে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। পশ্চিম এশিয়ার এই আরব দেশটি হচ্ছে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার মিলনস্থল। পাহাড় ও সাগর পরিবেষ্টিত লেবাননে বহিরাগতরাই দেশের চালিকাশক্তি। এক সময়ের ফরাসি উপনিবেশ লেবাননকে অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণেই বলা হয় মধ্যপ্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড বা প্যারিস। সেই লেবাননে কাজ করতে এসে ভাগ্য বদলের পাশাপাশি নানা অপকর্মেও জড়িয়ে পড়েছেন বাংলাদেশিরা। শনিবার বৈরুতের ডাউন টাউনে ঘুরতে গিয়ে আকিকে সিগার নামের একটি সিগারেটের চেইন শপে দেখা হয় কুমিল্লার দেবিদ্বারের ওয়াহেদপুর গ্রামের জহিরুল ইসলামের সঙ্গে। ১৯৯৭ সালে লেবানন আসা জহিরুল ইসলাম ২২ বছর ধরে এখানে কাজ করছেন। এই সিগারেটের দোকানেই কাজ করছেন ১৬ বছর। এখন বেতন পান ১৫০০ ডলারের কাছাকাছি। খেয়েপরে লাখ টাকার বেশি সঞ্চয় করতে পারেন। অথচ লেবাননে বাংলাদেশি শ্রমিকদের অধিকাংশের বেতন ২৫০/৩৫০ ডলার। জহিরুল ইসলামের মতো এমন সেলসম্যানের কাজ করছেন প্রথমদিকে আসা হাতেগোনা কয়েকজন। তিনি বলেন, আমার মতো হাজারখানেক লোক এখন এখানে আছে। ১৯৯৭-৯৮ সালে আমার সঙ্গে যারা এসেছিলেন তাদের অনেকে ইতালি, গ্রিস চলে গেছেন। ২০০৮ সালের পর মেয়েরা এদেশে ঢুকে আমাদের সুনাম নষ্ট করে দিয়েছে। মেয়েরা আজেবাজে কাজ করে বাঙালি কমিউনিটির বদনাম করছে। তিনি আরও বলেন, আমরা পুরুষরা অনেক নাম করেছিলাম। মেয়েরা দুই নম্বরি করে আমাদের পচাইয়া ফেলেছে। অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ হয়ে পড়া কিছু নারী শ্রমিক এখানে লিভ টুগেদারসহ অনৈতিক নানা কাজে জড়িয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশে তাদের স্বামী কিংবা স্ত্রী রয়েছেন। অথচ এখানে একসঙ্গে থাকছেন এমন অনেকেই। লেবানন প্রবাসী অসংখ্য বাংলাদেশি হাতেগোনা কিছু বাংলাদেশির কারণে বিপদে পড়ছেন। দালালদের অপতৎপরতায় তিন লাখ টাকা খরচের ভিসা এখন পাঁচ-ছয় লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এটি এক সময় আট লাখ টাকায়ও বিক্রি হয়েছে। রাজনৈতিক পরিচয়ের আড়ালে লেবাননে শ্রমিক হিসেবে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে অন্য বাংলাদেশিদের বিপদে ফেলছেন তারা। প্রায় ৪০ লাখ মানুষের দেশ লেবাননে দেড় লাখ বাংলাদেশি বিভিন্ন পেশায় কাজ করছে। তাদের মধ্যে বাংলাদেশি নারী অভিবাসীর সংখ্যা লক্ষাধিক। তাদের মধ্যে প্রায় ২০ হাজার বাংলাদেশি অবৈধভাবে বসবাস করছেন।

লেবানন ও সাইপ্রাসে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবদুল মোতালেব সরকার বলেন, বিভিন্ন কারণে অবৈধ হয়ে যাওয়া বাংলাদেশি শ্রমিকদের আকামা দেওয়ার জন্য আমরা আলোচনা করেছি। সরকার আশ্বাস দিয়েছে। তবে এখানে সব কাজ অনেক স্লো হয়। এখানে আরেকটা সমস্যা বেতন কম দেওয়া ও  চুক্তিবদ্ধ সময়ের চেয়ে বেশি সময় ধরে কাজ করানো। ছোটখাটো কোম্পানিগুলো এসব করে। দালালরা চুক্তির সময় মালিকদের বলে, তোমার শ্রমিকের কাছ থেকে আমাকে ২০ ডলার বা ৩০ ডলার দিতে হবে। তখন সেই টাকাটা তারা কম পায়। অভিযোগ পেয়ে আমরা এমন বেশ কিছু সমস্যার সমাধান করেছি। এখানে এমআরপি পাসপোর্ট করতে শুরুতেই তিন দিন আসতে হতো। সেটা আমরা অনেক সহজ করে দিয়েছি। এখন একজন ১৫/২০ মিনিটের মধ্যেই এমআরপির কাজ করতে পারেন। ভিড় থাকলে সময় একটু বেশি লাগে। পাসপোর্ট প্রিন্ট হয়ে এলে আমরা ফেসবুকে জানিয়ে দিই। তারা এসে নিয়ে যেতে পারে।  

সর্বশেষ খবর