মঙ্গলবার, ১৮ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

নয় লাখ শরণার্থী নিয়ে বিপাকে লেবানন

শিমুল মাহমুদ, বৈরুত (লেবানন) থেকে

নয় লাখ শরণার্থী নিয়ে বিপাকে রয়েছে লেবানন। পাশর্^বর্তী দেশ সিরিয়া এবং ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের কারণে লেবাননের সামাজিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু মানবিক কারণে যুগের পর যুগ তাদের আশ্রয় দিতে হচ্ছে লেবাননকে। এই দুই দেশের শরণার্থীদের চাপে লেবাননে বাংলাদেশিদের শ্রমবাজারও সংকুচিত হয়ে আসছে। শরণার্থীরা নামমাত্র মূল্যে কাজ করায় লেবানিজদের বাংলাদেশি শ্রমিক নির্ভরতা কমে গেছে। কমে গেছে কাজের চাহিদা। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর এর গত ৩১ মার্চের প্রতিবেদনে বলা হয়, লেবাননের বৈরুতসহ আশপাশেই মোট শরণার্থীর প্রায় ২৫ শতাংশ বসবাস করছে। সংখ্যার হিসাবে বৈরুতে আছে ২ লাখ ৩৭ হাজার শরণার্থী। তাদের কেউ কেউ প্রথম প্রজন্ম পেরিয়ে দ্বিতীয় প্রজন্ম পর্যন্ত শরণার্থী শিবিরে কাটিয়ে দিয়েছে। বৈরুত শহরের বাঙালি অধ্যুষিত সাবরা বাজারে বিশাল এক বহুতল ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবির। যুগের পর যুগ ধরে অমানবিক পরিবেশে ফিলিস্তিনিরা থাকছেন সেখানে। অন্যদিকে সবচেয়ে বেশি ৩৬ শতাংশ শরণার্থী থাকছে লেবাননের বেকা উপত্যকায়। সেখানে তিন লাখ ৪১ হাজার শরণার্থী কঠিন জীবনযাপন করছে। আমাদের কক্সবাজারের রোহিঙ্গাদের মতো লেবাননে সিরীয় এবং ফিলিস্তিনি শরণার্থীরাও দেশটির পানি, বিদ্যুৎ, পরিবেশের ওপর প্রভাব ফেলছে। যদিও শরণার্থীদের খাবারসহ যাবতীয় খরচ জাতিসংঘ বহন করছে। কিন্তু এই শরণার্থীরা লেবাননের পরিবেশ যেভাবে নষ্ট করছে তা অপূরণীয়। লেবাননের সাবরা বাজারের হোটেল ব্যবসা করেন বরিশালের বাসিন্দা গাজী রফিক। গত ২২ বছর ধরে এখানে আছেন তিনি। গাজী রফিক বলেন, এখানে শরণার্থীদের কারণে বাংলাদেশিদের কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে গেছে। তারা অল্প টাকায় কাজ করায় লেবানিজ মালিকরা সেই সুযোগটি নিচ্ছে। যদিও নিষ্ঠাবান কর্মী হিসেবে বাংলাদেশিদের সুনাম পুরো লেবানন জুড়ে। বৈরুতের ডাউন টাউনে দেখা মিলল কুমিল্লার দেবিদ্বারের জহিরুল ইসলামের। গত ১৬ বছর ধরে একটি সিগারেটের দোকানের সেলসম্যান তিনি। বেতন বাড়তে বাড়তে এখন ১ হাজার ৫০০ ডলার। বললেন, আমাদের মতো পুরনোরা এখন সংখ্যায় অনেক কম। তবে হাজারখানেক লোক আছে। ভালো জায়গায় ভালো বেতনে চাকরি করছেন তারা। বৈরুতের সোনার দোকানে, ম্যাকডোনাল্ডসে সেলসম্যান হিসেবে আছে বাংলাদেশিরা। পৌনে দুই লাখ বাংলাদেশি শ্রমিকের মধ্যে বাকিদের অবস্থা খুবই খারাপ।

এদিকে বৈরুতের ব্যস্ত রাস্তায় ভিক্ষা করছে প্রতিবেশী যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্র সিরিয়ার উদ্বাস্তুরা। শরণার্থী শিবিরের কঠিন বিধিনিষেধ ডিঙিয়ে তাদের কেউ জুতা পালিশ করছে। কেউ ফুল বিক্রির নামে সাহায্য চাইছে। আমাদের ঢাকার রাস্তার মতোই শিশুরা ভিক্ষা করছে ট্রাফিক সিগন্যালে। শীতের দুর্যোগপূর্ণ রাত কাটাচ্ছে বৈরুতের রাস্তার পাশে। ট্রাফিক সিগন্যালে সিরিয়ান নারীরা শিশু সন্তানদের নিয়ে বাড়িয়ে দিচ্ছে ভিক্ষার হাত। লেবানিজরা এটিকে বলে প্রকৃতির প্রতিশোধ। তাদের আশ্রয় দিলেও সাধারণ লেবানিজদের সহানুভূতি কম তাদের প্রতি। লেবানিজরা মনে করেন, তাদের জনপ্রিয় নেতা রফিক হারিরিকে হত্যা করেছে সিরীয়রা।

২০০৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি লেবাননের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরি এক গাড়িবোমায় নিহত হন। তিনি ছিলেন পশ্চিমা সমর্থিত ১৪ অ্যালায়েন্সের নেতা। তার হত্যাকান্ডে র জন্য অনেকে সিরিয়াকে দায়ী করে। কারণ, তখনো লেবাননে সিরিয়ার কয়েক হাজার সৈন্য ও গোয়েন্দা অবস্থান করছিল। পরে এর জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, সিরিয়া ও লেবাননের কয়েকজন উচ্চপদস্থ নেতা এর সঙ্গে জড়িত। তখন পশ্চিমা বিশ্বের চাপে সিরিয়া লেবানন থেকে তার ১৫ হাজার সৈন্য সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরিকে বলা হয় আধুনিক লেবাননের স্বপ্নদ্রষ্টা। তার দূরদর্শী কর্মতৎপরতার অনেক চিহ্ন আছে লেবাননজুড়ে। তাঁর ছেলে সাদ হারিরি বর্তমানে লেবাননের প্রধানমন্ত্রী।

সর্বশেষ খবর