শনিবার, ২২ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

লেবানন সৌন্দর্যে দৃষ্টি আগ্রাসী ইসরায়েলের

শিমুল মাহমুদ, বৈরুত (লেবানন) থেকে ফিরে

লেবানিজ নারীদের সৌন্দর্যের খ্যাতি বিশ^জুড়ে। বিশ্বের দেশে দেশে তারা ব্যবসা-বাণিজ্য এবং করপোরেট সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। শারীরিক সৌন্দর্য আর মেধার দীপ্তিতে নিজেদের পরিমন্ডলেও তারা পিছিয়ে নেই। নিজেদের সক্রিয় রাখতে পার্লার, ফিটনেস সেন্টার, জিমের ছড়াছড়ি বৈরুতের সর্বত্র। রাস্তায় গাড়িচালকদের প্রায় অর্ধেকই নারী। তারা নিজেদের গাড়ি নিয়ে দ্বিতীয় আরোহী ছাড়াই যে যার গন্তব্যে চলাফেরা করেন। পাহাড় কেটে তৈরি নান্দনিক সড়কে, টানেলে গাড়ির ভিড় চোখে পড়ার মতো। ব্যক্তিগত গাড়ির বাহুল্যে পরিচ্ছন্ন ফুটপাতে হেঁটে চলার মানুষ নেই। পরিপাটি এই শহরে সড়কসংলগ্ন ভূমধ্য সাগরের বুকে আছে চুনা পাথরের প্রাকৃতিক স্থাপনা পিজিয়ন রক বা লাইমস্টোন আইল্যান্ড। পর্যটকরা এর ভিতর দিয়ে বোটে করে ঘুরতে পছন্দ করেন। এটি বিশ্বখ্যাত এক প্রাকৃতিক স্থাপনা। পুরো লেবাননই যেন ছবির মতো সুন্দর সাজানো প্রকৃতি। বিস্তীর্ণ উঁচু পাহাড় আর ভূমধ্য সাগরের জলরাশি ঘেরা অসংখ্য সি-বিচের এ দেশ যেন প্রকৃতির উপচেপড়া সৌন্দর্যের আধার। বিশাল হাইওয়ের পাশে দিগন্তবিস্তীর্ণ সবুজের হাতছানি। ঘন সবুজ ফল ও ফসলের বাগান। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে তৈরি এ নান্দনিক সড়কে চলে বিশ্বের দামি সব ব্র্যান্ডের গাড়ি। সড়কের দুপাশে, সড়কদ্বীপে প্রচুর পরিমাণে বর্ণিল ফুলের গাছ দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। প্রকৃতিকে এতটা সযত্নে লালন করেছে তারা যা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। যেদিকে চোখ যায়, মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্যের ছড়াছড়ি। এ সুন্দর-সমৃদ্ধ দেশটির প্রতি ‘গরিবের সুন্দরী বউ’য়ের মতোই লোলুপ দৃষ্টি আগ্রাসী ইসরাইলের। জাতিসংঘ এসে মাঝপথে বাধার দেওয়াল তুলে না দাঁড়ালে লেবানন কবেই ইসরাইলের চারণভূমিতে পরিণত হতো। বর্তমানে ৪৩ দেশের ১০ হাজার ১২৪ জন শান্তিরক্ষী লেবাননের মাটিতে অবস্থান করছে। তাদের অধিকাংশই লেবাননের সীমান্ত সুরক্ষায় কাজ করছে। ছয় দেশের নৌবাহিনীর সদস্য ও যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে গঠিত ম্যারিটাইম টাস্কফোর্সের সদস্য বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সদস্যদের বিরত্বগাঁথা লেবাননজুড়ে। নৌবাহিনীর কর্মকাে র কারণে বাংলাদেশকে আলাদা শ্রদ্ধা ও সমীহের চোখে দেখে লেবাননের মানুষ এবং সরকার। লেবানন সফরের তৃতীয় দিন আমরা যখন জাতিসংঘ বাহিনীগুলোর কমান্ডিং কার্যালয় নাকুরায় ফোর্স হেডকোয়ার্টারে যাই তখন চারপাশের পরিবেশ থমথমে। ইসরাইল-লেবাননের সীমান্তসংলগ্ন এ এলাকায় লেবাননের কোনো গ্রামে ঢুকে ইসরাইলি বাহিনী জবরদস্তি চালিয়েছে বলে খবর আসে। আমরা ফোর্স কমান্ডারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেই বৈরুতে ফিরে আসি। ইসরাইলি আগ্রাসন নিয়ে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ ছিল না। আমাদের তিনটি প্রশ্ন ছিল লিখিত ও পূর্ব নির্ধারিত। দুই দেশের উত্তেজনার আরও একটি কারণ সমুদ্রসম্পদ আহরণ। লেবানন তার সমুদ্রসীমায় তেল, গ্যাস অনুসন্ধান শুরু করেছে। অন্যদিকে ইসরাইল কাছাকাছি এলাকা থেকে তেল, গ্যাস উত্তোলন শুরু করে দিয়েছে। লেবানন বলছে, এটি তাদের জায়গা। কিন্তু সমুদ্রসীমা চিহ্নিত না থাকায় কিছুই করতে পারছে না লেবানন। বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা তাদের পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক আদালতে যেতে। যেমন করে বাংলাদেশ ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি করেছে। অধিকাংশ সড়কের পাশেই বিশাল ফল বাগান। আপেল, কমলা, মালটা, কলার পরিকল্পিত চাষাবাদ। পাকা টসটসে কমলা পড়ে আছে গাছের নিচে। সংগ্রহ করা কিংবা খাওয়ার লোক নেই। বাংলাদেশের গ্রামের বাড়ির উঠোনের পাশের মাচার লাউ, সিম গাছের মতোই প্রতিটি বাড়িতেই ছোট-বড় অনেক আঙুর গাছ। তারা গ্রিন হাউসেও প্রচুর পরিমাণে ফল ও সবজির চাষ করে। তিন-চার ফুট লম্বা কলাগাছে বড় কলার ছড়া ঝুলে আছে। রাস্তার দুপাশে বিশাল সাইজের তরমুজ বিক্রি হচ্ছে। এত বড় তরমুজ এই প্রথম দেখা গেল। আমাদের সহযাত্রী এক কর্মকর্তা নাকুরা ফোর্স হেডকোয়ার্টার থেকে ফেরার সময় মাঝারি সাইজের ১৪ কেজি ওজনের একটি তরমুজ কিনলেন স্থানীয় ১১ হাজার টাকায়। যেটি ৭ ডলারের সমমূল্য। এখানকার সর্বত্র লেবানিজ মুদ্রার পাশাপাশি মার্কিন ডলারও সমানভাবে চলে। ডলারের রেট সারা বছরই প্রায় অভিন্ন। এক ডলারের সমান ১৫শ লেবানিজ মুদ্রা। সবচেয়ে বড় নোটটি হচ্ছে এক লাখ টাকার। একশ ডলার ভাঙিয়ে কচকচে দেড় লাখ টাকা পাওয়া গেল। মনে হলো, সঙ্গে থাকা সব ডলার ভাঙালে মুহূর্তেই লাখ লাখ টাকার মালিক হওয়া যাবে।

সর্বশেষ খবর