রবিবার, ২৩ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

জরিমানা ছাড়াই দেশে ফিরতে চান প্রবাসীরা

শিমুল মাহমুদ, বৈরুত (লেবানন) থেকে ফিরে

জরিমানা ছাড়াই দেশে ফিরতে চান প্রবাসীরা

এক কেজি করলা, ঢেঁড়স কিংবা পুঁইশাক, কাঁচা মরিচের দাম তিন থেকে চার ডলার। বাংলাদেশি ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা। মাসে ২৫০ কিংবা ৩০০ ডলার বেতন পেয়ে এই দামে শাক-সবজি কিনে কীভাবে জীবন বাঁচাবেন লেবানন প্রবাসীরা। যদিও বাঙালিদের চাহিদার কারণে সবজি চাষ করে কয়েকজন লেবানন প্রবাসী বাংলাদেশি কোটিপতি হয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, লেবাননের প্রায় পৌনে দুই লাখ প্রবাসী বাংলাদেশির মধ্যে একটা বড় অংশ সীমাহীন কষ্টে আছেন। দালালের পাল্লায় পড়ে তারা প্রতারিত হয়েছেন। তাদের বৈধ কোনো কাগজপত্র নেই। কাজের কোনো জায়গা নেই। নির্ধারিত কোনো বেতন নেই অনেকের। তারা দেশে ফিরে আসতে চান। কিন্তু ফেরার পথও খোলা নেই। যাদের বৈধ কাগজপত্র নেই তাদের বছর প্রতি ২৭০ ডলার করে জরিমানা দিয়ে দেশে ফিরতে হয়। দালালের মিষ্টি কথায় ভুলে কেউ হয়তো গেছেন পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে। গিয়ে কাক্সিক্ষত কাজ না পেয়ে, বার বার প্রতারিত হয়ে অবৈধ হয়ে পড়েছেন। পাঁচ বছর অবৈধ থাকলে তাকে ১৩৫০ ডলার জরিমানা এবং বিমান ভাড়া দিয়ে দেশে ফিরতে হয়। যার কোনো বেতন নেই, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা নেই সে এই দেড় লাখ কিংবা তারও বেশি টাকা দিয়ে দেশে ফিরবেন কীভাবে। গত কয়েক দিনে লেবাননের বিভিন্ন শপিং মল ও বিপণি কেন্দ্রে অসংখ্য বাংলাদেশির দেখা মিলেছে, যারা পরিচয়ের পরপরই বলেছেন, ভাই অনেক কষ্টে আছি। দেশে ফিরে যেতে চাই।  বৈরুতের সিটি সেন্টারে ক্যাশ কাউন্টারের কাছে পালা করে প্রায় ২৫ জন বাঙালি কাজ করেন। তাদের কারোরই বৈধ কাগজপত্র নেই। ফলে তাদের কোনো বেতনও নেই। তারা ক্রেতাদের কেনাকাটার ব্যাগ গুছিয়ে দেন। জিনিসপত্র ব্যাগে ভরে দেন। আরেক গ্রুপ শপিংয়ে ঢোকার আগে ক্রেতাদের ব্যাগ জমা রাখেন এবং যাওয়ার সময় ফিরিয়ে দেন। ক্রেতারা খুশি হয়ে যা টিপস দেয় তাতেই তারা খুশি। তা দিয়েই চলে তাদের জীবন। এই সিটি সেন্টারে, বাঙালিদের মিলনকেন্দ্র সাবরা বাজারে, নূহ নবীর মাজারে অসংখ্য বাঙালির দেখা মিলল, যারা দেশে ফিরতে চান জরিমানা ছাড়াই। কারণ, জরিমানা ও বিমান ভাড়া দিয়ে দেশে ফেরার সঙ্গতি তাদের কারও নেই। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ দূতাবাস প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য একটি সাধারণ ক্ষমার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সরকার থেকে আশ্বাস পাওয়া গেছে। অবশ্য লেবাননে নিযুক্ত বর্তমান রাষ্ট্রদূত আবদুল মোতালেব সরকার এর আগে দুই দফায় ৭ হাজার অবৈধ বাংলাদেশি শ্রমিককে বিনা জরিমানায় দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন। ২০১৫ সালে তিনি লেবানন দূতাবাসে যোগ দিয়েই কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে ২০১৬ সালে প্রায় তিন হাজার অবৈধ প্রবাসীকে জরিমানা ছাড়া দেশে ফেরার সুযোগ করে দেন। তার অক্লান্ত চেষ্টায় সর্বশেষ গত বছরের জুলাইয়ে কয়েক দফায় চার হাজার বাঙালি শ্রমিক জরিমানা ছাড়া দেশে ফিরেছেন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত আবদুল মোতালেব সরকার বলেন, সরকারের কূটনৈতিক সাফল্যে জরিমানা ছাড়াই লেবানন থেকে অবৈধ হয়ে পড়া শ্রমিকদের দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারা দেশে ফিরতে চাইলেও মোটা অঙ্কের ইমিগ্রেশন জরিমানার কারণে ফিরতে পারছিলেন না। লেবানন সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে সফল আলোচনার মাধ্যমে শুধু বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসীরা এই জরিমানা মওকুফ পায়। অনেক বাংলাদেশি ১৫/২০ বছর পর্যন্ত লেবাননে ছিলেন, তাদের জন্য এত বড় অঙ্কের জরিমানা দিয়ে দেশে ফেরা সম্ভব ছিল না।

মোতালেব সরকার বলেন, বাংলাদেশের জন্য এটি একটি অনেক বড় কূটনৈতিক সাফল্য। অনেক নারীর দেশে ফেরার টিকিটের টাকা ছিল না। আমি ব্যক্তিগতভাবে কয়েকটি এনজিওর সঙ্গে যোগাযোগ করে টিকিটের টাকা জোগাড় করে দিয়েছি।

লেবাননে অবৈধভাবে ১৮ বছর থাকার পর বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তায় দেশে ফিরে আসা মফিজুল আলম বলেন, দীর্ঘদিন লেবাননে থেকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। আমার জরিমানা হয়েছিল বাংলাদেশি টাকায় প্রায় চার লাখ। অসুস্থ হয়ে অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। কাজ করতেও খুব কষ্ট হতো। জরিমানার কারণে দেশে ফিরতে পারছিলাম না। বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তায় আমি ফিরেছি। আমার সঙ্গে এক মহিলাও এসেছেন, তাকে টিকিটও করে দিয়েছে দূতাবাস। রাষ্ট্রদূত আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। দেশে ফেরত আসা কয়েকজন বাংলাদেশি জানান, লেবাননের আইন অনেক জটিল। সেখানে সারা জীবন থাকলেও কেউ বৈধ হতে পারবেন না। কঠিন ইমিগ্রেশন আইনের কারণে চাইলেও কেউ দেশে ফিরতে পারবেন না। অবৈধভাবে থাকায় দেশে আসতে না পেরে অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। জরিমানা মওকুফের আগে অসুস্থ কয়েকজন দেশের জমি বিক্রি করে টাকা নিয়ে ফিরেছেন। রাষ্ট্রদূত আবদুল মোতালেব সরকার জানান, আবারও জরিমানা ছাড়া অবৈধ প্রবাসীদের দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে তিনি চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। লেবানন সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে এ ব্যাপারে আশ্বাস পাওয়া গেছে। আশা করা হচ্ছে, শিগগিরই বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশিকে কোনো জরিমানা ছাড়াই দেশে পাঠানো সম্ভব হবে।

সর্বশেষ খবর