সোমবার, ২৪ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

কাজের সন্ধানে বিহারিরা

কাপড়ের ব্যবসা মূল পেশা সৈয়দপুরের বিহারিদের, চট্টগ্রামের বিহারিরা করেন কারচুপির কাজ, কাজ না থাকায় ১৩-১৪ বছরেই কিশোরীদের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে

গোলাম রাব্বানী ও জিন্নাতুন নূর

কাজের সন্ধানে বিহারিরা

চট্টগ্রামে বিহারি পল্লীতে নারী-পুরুষ পোশাকে কারচুপির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন

দুবেলা দুমুঠো খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার জন্য হন্যে হয়ে কাজ খুঁজছেন আটকে পড়া পাকিস্তানি তথা বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দারা। পুরুষরা যুগ যুগ ধরে কারচুপি কাজ করে এলেও নারীদের অবস্থা শোচনীয়। কাজ না থাকায় ১৩-১৪ বছর বয়সেই বিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিহারি কিশোরীদের। ঢাকা-চট্টগ্রাম ছাড়াও নীলফামারীর সৈয়দপুর শহরে ২২টি ক্যাম্পে বসবাস করেন বিহারিরা। এই এলাকার কিছু বিহারি রেল কারখানায় কাজ করলেও অনেকেরই পেশা কাপড় ব্যবসা। সরু গলির দুই পাশে ছোট ছোট ঘরে তাদের বসবাস। সৈয়দপুরের অনেক ক্যাম্পে মোমবাতি-আগরবাতি ও বিস্কুটের কারখানায় কাজ করেন অনেকেই। চট্টগ্রামের বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দাও মূলত কারচুপির কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করেন। বিশেষ করে ঈদের আগে তাদের কদর বেশি থাকে। তবে ক্যাম্পের একটি ঘরে তাদের তিন সংসারের বসবাস। মেয়ে তার বাবার ঘরেই থাকেন স্বামী-সন্তান নিয়ে। আবার একই ঘরে ছেলেও থাকেন তার বউ-বাচ্চা নিয়ে। বলা চলে দেশের সব বিহারি ক্যাম্পের অবস্থা একই। মিরপুরে বেশ কয়েকটি স্থানে আটকে পড়া পাকিস্তানিরা বাস করছে। এর মধ্যে আছে কুর্মিটোলা (বগুড়া ক্যাম্প), পূর্ব কুর্মিটোলা ক্যাম্প, মুসলিমবাজার বিহারি ক্যাম্প, ১১ নম্বরের মিল্লাত ক্যাম্প, ওয়াপদা ক্যাম্প। সরেজমিন ঘুরে প্রায় সব ক্যাম্পে কর্মসংস্থানের এই চিত্র দেখা গেছে। ক্যাম্পের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, তারা সম্মানজনক কাজ খুঁজছেন। কিন্তু শিক্ষিত হওয়ার পরও তাদের কেউ কাজ দিচ্ছে না। এ জন্য তাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই এখন কারচুপির কাজ করেন। কেউ কেউ বেনারসি পল্লীতে কাজ করেন। আবার যারা কিছুটা সচ্ছল তারা শিক-কাবাবের দোকান দিয়েছেন। কিন্তু এই সংখ্যা খুব বেশি নয়। কেউ কেউ এসব কাবাবের দোকানে কাজ করেন। অনেকে রিকশা চালান। আবার মোটরসাইকেলের গ্যারেজেও কাজ করেন অনেক যুবক।

মোহাম্মদ হোসেন নামের এক বিহারি যুবক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বেশি লেখাপড়া করিনি। কিছুদিন কারচুপির দোকানে কাজ করেছি। আবার মৌসুমি ফলের ব্যবসা করি। আনারস ও ভুট্টা বিক্রি করি। এতেই কোনো রকম সংসার চলে। মিরপুরে পূর্ব কুর্মিটোলা বিহারি ক্যাম্পের ইপুনি নামের এক নারী বলেন, ‘আমাদের ক্যাম্পে মেয়েদের কাজ করার তেমন সুযোগ নেই। কাজ না থাকায় বাবা কম বয়সেই আমার বিয়ে দিয়ে দেন। ক্যাম্পের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, কাজ না পেয়ে অনেক বিহারি যুবক এখন হতাশায় মাদক গ্রহণ করছে। আবার কেউ কেউ মাদকের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। বিহারি নারী ও তরুণীরা তেমন কোনো কাজ করে না। এদের অধিকাংশই বেশি দূর লেখাপড়ার সুযোগ পায় না। আর ঘর থেকে বাইরে বের না হওয়ায় কাজের সুযোগও কম। হাতে গোনা কয়েকজন তরুণী তাদের বাবাকে কারচুপির ব্যবসায় সাহায্য করে। বাকি অধিকাংশেরই বয়ঃসন্ধিকালে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। ফলে খুব অল্প বয়সেই তারা সন্তান জন্ম দিচ্ছে। মিরপুরের পূর্ব কুর্মিটোলার বিহারি ক্যাম্পে গিয়ে কথা হয় শবনম নামের এক নারীর সঙ্গে। তিনি আক্ষেপের সুরে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, দরিদ্রতার কারণে তিনি বেশ কিছুদিন ধরে কাজ খুঁজছেন। প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত খুঁজেও কোনো কাজ পাচ্ছেন না। গৃহকর্মের কাজের জন্যও চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তার ভাষা ও পরিচয় পাওয়ার পর মানুষ তাকে আর কাজ দিতে চান না।

মিরপুরের মুসলিমবাজার বিহারি ক্যাম্পের স্থানীয়রা জানান, বিহারি নারী-পুরুষের পাশাপাশি তাদের শিশু-কিশোররাও কাপড়ে ব্যবহৃত জরির কারখানায় কাজ করে। কিছু শিশু-কিশোর টেম্পোর হেলপার ও কুলির কাজও করে। মিরপুর ১১ নম্বর বিহারি ক্যাম্পের ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থী চাঁদনী জানায়, স্কুলে ভর্তিসহ অন্যান্য খরচ জোগাতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। এ জন্য স্কুল থেকে ফিরেই সে তার বাসার ছোট কারখানায় জরির কাজ করে পরিবারকে সাহায্য করে। বাসস্থান সংকটে আছে মিরপুর কালশীর কুর্মিটোলা ক্যাম্পের বিহারিরাও। প্রথমে কুর্মিটোলায় (বগুড়া ক্যাম্প) বসবাস শুরু করলেও জনবসতি বৃদ্ধি পাওয়ায় রাস্তা পার হয়ে এই ক্যাম্পটি এখন পূর্ব কুর্মিটোলা নামে আরেকটি ক্যাম্পের জন্ম দেয়। এই ক্যাম্পের উঁচু-নিচু স্থানে সরু গলিগুলোর-ভিতর ময়লা-দুর্গন্ধময় পরিবেশে এক-একটি ঘরে একসঙ্গে অনেকজন বাস করেন। এই ক্যাম্পের অনেক ছেলে-মেয়ে উচ্চশিক্ষিত হলেও তারা শুধু বিহারি পরিবারে জন্ম নেওয়ায় চাকরি পাচ্ছে না। আবার দরিদ্র এই মানুষগুলো চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে না পেরে ডাক্তারের বদলে ফার্মেসিতে গিয়ে ওষুধ কিনে দিন পার করছে। এই ক্যাম্পে বাংলাদেশ বিহারি পুনর্বাসন সংসদ নামের একটি সংগঠন আছে। সংগঠনটি বিহারিদের সুযোগ-সুবিধা দেখভাল করে। এর সভাপতি ওসমান গনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশেই থেকে যেতে চাই। কিন্তু বর্তমানে আমাদের থাকার জায়গা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের কোনো সুযোগ-সুবিধাও দেওয়া হচ্ছে না। বিশেষ প্রয়োজনে আমরা নিজেরাই টাকা তুলে সমস্যার সমাধান করি। আমাদের কাজেরও খুব অভাব। ছেলেমেয়েরাও সম্মানজনক কোনো কাজ করতে পারছে না।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের বিহারি সম্প্রদায়ের মানুষ প্রান্তিক অবস্থায় জেনেভা ক্যাম্পে আটকে ছিলেন। লেখাপড়ার সুযোগ কম থাকায় তারা প্রান্তিক বিভিন্ন পেশায় জড়িয়ে পড়েন। তবে গত কয়েক বছরে মূলধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত  হতে শুরু করলেও এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্চশিক্ষিত মানুষের সংখ্যা তুলনামূলক কম। এই উর্দুভাষীরা তাদের নিজস্ব ট্রাডিশনাল কিছু কাজ ভালো পারেন। রেলওয়ের কারখানায় তারা ভালো কাজ করেন। আবার অনেকেই সেলুনের কাজে দক্ষ। কিন্তু সেলুন মালিক হিসেবে নয় কর্মী হিসেবে। এসব কাজে যদি তাদের কর্মদক্ষতা উন্নয়নে মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করা হয় তবে তাদের মধ্যে কর্মসংস্থানের হার বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এই জনগোষ্ঠীকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যদি মূলধন সহায়তা দেওয়া হয় তবে তাদের সুবিধা হবে। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলো থেকেও যদি বিহারিদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য ব্যাংক ঋণ সুবিধা দেওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে তারা উপকারভোগী হবেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর