মঙ্গলবার, ২৫ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

পর্যটনসমৃদ্ধ লেবাননে বিরল সমঝোতা

শিমুল মাহমুদ, বৈরুত (লেবানন) থেকে ফিরে

খ্রিস্টানদের এলাকায় শুধু খ্রিস্টানরাই বসবাস করে। সুন্নি মুসলিমদের এলাকায় শুধু সুন্নিদেরই বসবাস। শিয়া মুসলিম কিংবা হিজবুল্লাহদের এলাকায় অন্য কোনো সম্প্রদায়ের আনাগোনা নেই। ধর্মীয় এই বিভাজনের মধ্যেও লেবাননে সরকার ব্যবস্থায় এক অভাবনীয় রাজনৈতিক ঐক্যতান বজায় রেখেছে তারা। সামাজিক বিভাজন থাকলেও মধ্যপ্রাচ্য বা অন্য আরব দেশের মতো অভ্যন্তরীণ হানাহানিতে নেই  লেবানিজরা। আরব দেশ হলেও লেবাননে রাজতন্ত্র কিংবা পরিবারতন্ত্র নেই। এখানে খ্রিস্টান ও মুসলমানরা নজিরবিহীন সমঝোতার মাধ্যমে সরকার পরিচালনা করে ধর্মীয় সংখ্যানুপাতের ভিত্তিতে। ফলে, রাজনীতি নিয়ে লেবাননে দৃশ্যমান কোনো সংকট নেই। ধর্ম নিয়েও সংঘাত নেই। সরকারে ও সমাজে খ্রিস্টানদের সঙ্গে মিলেমিশে আছে মুসলিমরা। পাশাপাশি অবস্থিত মসজিদ ও গির্জায় দুই সম্প্রদায়ই নিজেদের নির্বিঘ্ন উপাসনায় লিপ্ত। পারস্পরিক সম্প্রীতির এমন নজির বিশ্বে বিরল। দেশটির আইনানুসারে প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন একজন ম্যারোনেইট খ্রিস্টান, প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন সুন্নি মুসলমান, স্পিকার হচ্ছেন শিয়া মুসলমান। সেখানকার সংসদীয় আসনগুলো মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের মধ্যে সমানভাগে ভাগ করা। দেশের সংসদ চার বছরের জন্য নির্বাচিত হয়। সংসদ দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে। পরে প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করেন। লেবাননের সরকারি ভাষা আরবি, এ ছাড়া ফ্রেন্স, ইংরেজিও চলে সমানতালে। নামে মুসলিম দেশ হলেও সংস্কৃতিতে পশ্চিমাদের চেয়েও অগ্রসর। স্বল্প বসনা উর্বশীর পাশাপাশি হেঁটে বেড়ায় হিজাব পরা মুসলিম নারীরা। রবিবার ও অন্যান্য সরকারি ছুটির দিনে দলবেঁধে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে লোকজন। গান গায়, হুক্কা খায়। সিসা নামের হুঁকা লেবাননের তরুণ তরুণীদের অনেক পছন্দের। লেবানিজ সাহিত্যের বড় তারকা ‘দি প্রফেট’ খ্যাত খলিল জিবরানকে নিয়ে অসম্ভব গর্ব করেন তারা। পর্যটনই মূলত লেবাননের অর্থনীতির চালিকা শক্তি। সামারে লেবাননের পর্যটন স্পটগুলোকে লাখো পর্যটকের ভিড় জমে। ২০০৬ সালের ইসরাইল- লেবানন যুদ্ধের আগে লেবাননে ছিল স্থিতিশীল অবস্থা। যুদ্ধের পর বৈরুত তার পুরনো ক্ষতগুলো মুছে ফেলতে সক্ষম হয়। লাখো পর্যটক আবারও বিমোহিত হয় লেবাননের সৌন্দর্যে। লেবাননের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি পর্যটকও বেড়াতে যায় গত বছর। লেবাননের সুন্দর আবহাওয়া, অগণিত ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান প্রতি বছরই পর্যটককে টানে লেবানন ভ্রমণে। পর্যটন থেকেই লেবাননের অর্থনীতি বিকশিত হয়। জনগণ খুঁজে নেয় তাদের আয়ের রাস্তা। লেবাননের পর্যটন খাতে দেশটির জনশক্তির মোট ৬৫ শতাংশ জড়িয়ে আছে। মোট আয়ের ৬৭ শতাংশ আসে এই পর্যটন খাত থেকেই। এ ছাড়া লেবাননের আয়ের ক্ষেত্রে রেমিট্যান্স এখন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। প্রতি বছর এর পরিমাণ ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি, যা দেশটির মোট আয়ের এক-পঞ্চমাংশ। লেবানন ইউরোপ এবং আরব দেশগুলোতে প্রচুর দক্ষ ও প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন কর্মী পাঠিয়ে থাকে।  লেবাননের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ি এলাকা ফারায়ায় শীতের পুরো সময় বরফে ঢেকে যায় ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট। অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে জনজীবন। কিন্তু পর্যটকরা সেই বরফ দেখতে গিয়ে অনাবিল আনন্দ লাভ করে। অনেকে বরফের মধ্যে স্কি করে। সপরিবারে গিয়ে উপভোগ করে। জৈয়িতা নামের হাজার বছরের পুরনো গুহাটি তারা সংরক্ষণ করছে পর্যটকের দর্শনীয় স্থান হিসেবে। সেখানে পাহাড়ের ভিতরে প্রাকৃতিকভাবে এমন দৃষ্টিনন্দন লাইমস্টোন  তৈরি হয়েছে যা দর্শনার্থীদের অভিভূত করে। নৃতাত্ত্বিক তথ্য-প্রমাণ অনুযায়ী, লেবাননের রয়েছে কয়েক হাজার বছরের পুরনো অতীত। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৩ সালে এটি ছিল পারস্য সামাজ্যের অন্তর্ভূক্ত। এরপর ৩৯৫ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রোমান সাম্রাজ্য, ৬২২ পর্যন্ত বাইজাইনটাইন এবং ৭৫০ সাল পর্যন্ত উম্মাইয়াদ শাসনে ছিল। এরপর ১১১০ সাল পর্যন্ত আব্বাসিয়া, ১২৯১ পর্যন্ত ক্রুসেডার্স এবং ১৫১৬ সাল পর্যন্ত মামলুক শাসনের অন্তর্ভুক্ত ছিল ১৯২০ সাল পর্যন্ত। লেবানন ফ্রান্স মেনডেটের অন্তর্ভুক্ত থাকে ১৯২০ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত। ১৯৪৩ সালের পর স্বাধীনতার স্বাদ পায় লেবাননবাসী। লেবাননের বালবেক, বিবলস, টায়ারসহ বিভিন্ন এলাকায় অতীত শাসকদের দুর্গ, মন্দিরসহ বিভিন্ন স্থাপনা এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। এক সময় সুইজারল্যান্ডের মতোই পূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল লেবাননে। তবে এখনো সংঘাত সহিংসতা যা আছে তা পার্শ্ববর্তী দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে। ইসরায়েল একাধিকবার সশস্ত্র হামলা চালায় লেবাননে। বর্তমানে জাতিসংঘের তৎপরতায় দেশটিতে স্বস্তির পরিবেশ রয়েছে। লেবাননের সবচেয়ে শক্তিশালী সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ গত কয়েক বছর ধরে নীরব।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর