বুধবার, ২৬ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা
গবেষণা প্রতিবেদন

পদে পদে যৌন হয়রানির শিকার নারী পোশাকশ্রমিক

কারখানায় অনিরাপদ ৩৯% শ্রমিক, যানবাহন মুদি দোকান সবখানেই হয়রানি

নিজস্ব প্রতিবেদক

কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ বোধ করেন না দেশের ৩৯ শতাংশ নারী পোশাকশ্রমিক। কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ নিয়ে তাদের অসন্তুষ্টি রয়েছে। এর প্রধান কারণ হলো যৌন হয়রানিসহ শারীরিক নির্যাতন। কর্মক্ষেত্রে ৯০ শতাংশ নারী শ্রমিক মানসিক নির্যাতন, ৫১ শতাংশ শারীরিক নির্যাতন এবং ৪৩ শতাংশ যৌন হয়রানির শিকার হন। ‘কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি নির্যাতন ও হয়রানি : প্রেক্ষিত বাংলাদেশের পোশাকশিল্প’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে আসে। গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, পাড়ার মুদি দোকানদার থেকে শুরু করে এলাকার বখাটে, কারখানার মধ্য ও উচ্চসারির কর্মকর্তা সবাই এই শ্রমিকদের যৌন হয়রানি করে। অর্থাৎ নারী পোশাকশ্রমিককে পদে পদে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়। রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে গতকাল সকালে এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ১. বাংলাদেশ শ্রম অধিকার ফোরাম ও নাগরিক উদ্যোগ একটি গবেষণা পরিচালনা করে। ২. ঢাকার মোহাম্মদপুর, মিরপুর, আশুলিয়া, টঙ্গী, তুরাগ, ধামরাই, উত্তরা, মালিবাগ, খিলগাঁও, রামপুরা, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ ও নারায়ণগঞ্জ এলাকার পোশাকশ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ শ্রম অধিকার ফোরামের আহ্বায়ক আবুল হোসাইন, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স ও নারী পক্ষের প্রকল্প পরিচালক রওশন আরা উপস্থিত ছিলেন। গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, শারীরিক শাস্তির মধ্যে ২৪ শতাংশ চড়-থাপ্পড়, ২৮ শতাংশ প্রহার, ধাক্কা দেওয়া ৩০ শতাংশ এবং চুল ধরে টানা হয় ১৬ শতাংশ নারী শ্রমিককে। মানসিক নির্যাতনের বিভিন্ন ধরনের মধ্যে আছে ধমক দেওয়া, গালি দেওয়া, চাকরি থেকে বের করে দেওয়া ইত্যাদি। যৌন নির্যাতনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শরীরে অনাকাক্সিক্ষত স্পর্শ, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি, অশ্লীল মন্তব্য ইত্যাদি। সাধারণত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারী কর্মীদের চাকরি হারানোর ঝুঁকিকে ব্যবহার করেই নির্যাতন করা হয়। নারী কর্মীরা যখন তাদের ঊর্ধ্বতনদের কথা শোনেন না তখনই তাদের নানা ধরনের নির্যাতনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ১৬ শতাংশ জানান, কথা না শুনলে তাদের কাজের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নাইট ডিউটি দেওয়া হয়। তবে শারীরিক, মানসিক ও যৌন হয়রানির পাশাপাশি কারখানা ধসে পড়া ও অগ্নিনিরাপত্তা নিয়েও শ্রমিকরা উদ্বিগ্ন থাকেন। নারী শ্রমিকরা যে এলাকায় থাকেন সেখানে পদে পদে তারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এই শ্রমিকরা যেসব মুদি দোকানে কেনাকাটা করেন সেখানে বাকি-বকেয়া থাকলে দোকানদাররা তাদের কাছ থেকে অনৈতিক সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে। এ ছাড়া ৬৬ শতাংশ জানান, পাড়ার উঠতি বয়সী যুবক ও তরুণরা শ্রমিকদের গায়ে হাত দিয়ে বাজে মন্তব্য করে তাদের হয়রানি করে। নাইট ডিউটি করে ফেরার সময়ও তাদের যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়। এ ছাড়া কাজে যাওয়ার পথে যানবাহনেও ৭৭ শতাংশ নারী শ্রমিক নানা রকমের হয়রানির শিকার হন। ৪৩ শতাংশ কর্মী জানান, তাদের শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে পুরুষ যাত্রীসহ বাসের কনডাক্টর-হেলপাররা হাত দেন। ৩৫ শতাংশ শ্রমিক জানান, বাসে বসা পাশের পুরুষ যাত্রী মোবাইলে পর্ন দেখেন এবং তাদেরও দেখানোর চেষ্টা করেন। ৫ শতাংশ শ্রমিক জানান, যদি তারা এর প্রতিবাদ করেন তবে তাদের ‘খারাপ মেয়েলোক’ বলে মন্তব্য করা হয়। তবে সবচেয়ে বেশি নিচের স্তরের তরুণী কর্মীরাই হয়রানির শিকার হন। কাজে ভুল হলে বা দেরি করে কর্মস্থলে এলে তাদের প্রতি সুপারভাইজাররা খারাপ ভাষা ব্যবহার করেন এবং গায়ে হাত তোলার হুমকি দেন। ১৭ শতাংশ নারী শ্রমিক জানান, লাইন সুপারভাইজার, ফ্লোর সুপারভাইজার ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কথা বলার ছলে তাদের পিঠে চাপড় দেন, গাল ধরে টান দেন ও মাথায় হাত বোলান। শ্রমিকরা আরও জানান, ১৪ শতাংশ অনৈতিক সম্পর্কের প্রস্তাব পেয়েছেন। ৩১ শতাংশ কর্মীর মতে শিক্ষানবিসকালেই তারা সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার হন। অফিসে দেরি করলেই তাদের নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হতে হয়। ৪৫ শতাংশ জানান, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রায়ই তাদের প্রলোভন দেখিয়ে অনৈতিক সম্পর্কের প্রস্তাব দেন। নির্যাতিত নারীরা জানান, কারখানায় তাদের অভিযোগ করার জন্য আনুষ্ঠানিক কোনো ডেস্ক নেই। কারখানা কর্তৃপক্ষ মনে করে, নারীদের প্রতি নির্যাতন-হয়রানি বড় কোনো সমস্যা নয়।

সর্বশেষ খবর