রবিবার, ৩০ জুন, ২০১৯ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গা নৃশংসতার বিচার প্রক্রিয়া

মানবতাবিরোধী অপরাধের পূর্ণ তদন্ত শুরুর পথে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ঘোষণা প্রত্যাখ্যান মিয়ানমার সেনাবাহিনীর

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

রোহিঙ্গা নৃশংসতার বিচার প্রক্রিয়া

মিয়ানমারে নিপীড়নের মুখে পালিয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আসার ঘটনায় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগের পূর্ণ তদন্তের শুরুর পথে এগিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)। প্রাথমিক তদন্ত শেষে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শুরুর জন্য তিন বিচারকের একটি বেঞ্চ ঠিক করে দিয়েছেন নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত এই আদালতের প্রধান। আবেদন মঞ্জুর হলে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে নৃশংসতার অভিযোগের তদন্তে এটাই হবে প্রথম কোনো আন্তর্জাতিক আদালতের উদ্যোগ। পূর্ণাঙ্গ এই তদন্ত হবে মিয়ানমারের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার অন্যতম ধাপ। এর পরই  আনুষ্ঠানিক বিচারকাজে বসবে আদালত। জানা যায়, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সদস্য নয় এমন দেশে সংঘটিত অপরাধের বিচার করার সরাসরি কোনো এখতিয়ার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) নেই। কিন্তু রোহিঙ্গারা যেহেতু মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে, বিষয়টি যেহেতু আন্তসীমান্ত অপরাধ এবং বাংলাদেশ যেহেতু আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সদস্য, সেহেতু আইসিসি বিষয়টি তদন্ত ও বিচার করতে পারেÑ এ যুক্তি রেখে গত বছর এপ্রিলে একটি আবেদন করেন ওই আদালতের প্রসিকিউটর ফাতোও বেনসুদা। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য এবং বিভিন্ন অধিকার সংগঠনের যুক্তি শুনে আইসিসির তিন বিচারকের প্রি-ট্রায়াল প্যানেল গত বছর ৬ সেপ্টেম্বর সিদ্ধান্ত দেয়, এ বিষয়টি বিচারের এখতিয়ার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রয়েছে। এর পরই শুরু হয় প্রাথমিক তদন্ত। এখন প্রাথমিক তদন্ত শেষে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শুরুর জন্য একইভাবে প্রসিকিউটর ফাতোও বেনসুদার আবেদনের ওপর শুনানি হবে। এক বিবৃতিতে বেনসুদা বলেন, ঘটনার একটি পক্ষ বাংলাদেশ আইসিসির সদস্য হওয়ার যুক্তি তুলে ধরে তিনি এ অভিযোগ তদন্তের জন্য বিচারকদের কাছে অনুমতি চাইবেন। মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে সংঘটিত অপরাধকে কেন্দ্র করে এর তদন্ত হবে। পূর্ণাঙ্গ এ তদন্ত শেষ হলেই আনুষ্ঠানিক বিচারকাজ শুরু হবে।

আইসিসির উদ্যোগে আন্তর্জাতিক সমর্থন : রোহিঙ্গা গণহত্যা ও জাতিসংঘ সনদ লঙ্ঘনের অভিযোগে মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে বিচারের মুখোমুখি করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন কানাডার ৩৪ সিনেটর ও শতাধিক মানবাধিকার সংগঠন। কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ডের কাছে পাঠানো যৌথ চিঠিতে রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিষয়ে আইসিসি যাতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয় সেজন্য কানাডাকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। রাখাইনে রোহিঙ্গা গণহত্যা ও নির্যাতনের জন্য মিয়ানমারকে যে কোনো মূল্যে জবাবদিহির আওতায় আনার কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত কানাডার হাইকমিশনার বেনোয়া প্রিফতেন। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের ওপর যে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে তা ভুলে গেলে চলবে না। আমরা যদি এটি ভুলে যাই তাহলে অন্য কোথাও আবার এ ধরনের ঘটনা ঘটবে। মিয়ানমার এ ধরনের অপকর্ম করে পার পেয়ে গেলে সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য এটি মোটেই মঙ্গলজনক হবে না।’ অন্যদিকে আন্তর্জাাতিক বিচার কমিশনের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পরিচালক ফেডেরিক রাওসাকি আইসিসির তদন্তের উদ্যোগকে যথাযথ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের বিচার নিশ্চিতে পুরোপুরি অনীহা ও অযোগ্যতা প্রমাণ করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।

প্রত্যাখ্যান মিয়ানমার সেনাবাহিনীর : রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নিপীড়নের ঘটনা তদন্তে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। আইসিসির পূর্ণাঙ্গ তদন্তের উদ্যোগ মিয়ানমার ও সে দেশের সেনাবাহিনীর মর্যাদায় আঘাতের শামিল বলে মন্তব্য করেছেন দেশটির সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জ মিন তুন। আইসিসির পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শুরু করার ঘোষণার এক দিনের মাথায় তা প্রত্যাখ্যান করল মিয়ানমার সেনাবাহিনী। বার্তা সংস্থা এএফপিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জ মিন তুন বলেন, রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিষয়ে ইতিমধ্যে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে মিয়ানমার সরকার। আইসিসির উচিত মিয়ানমার সরকারের তদন্ত কমিটিকে সম্মান জানানো। রোহিঙ্গাদের ওপর যারা নির্যাতন চালিয়েছিল মিয়ানমার সরকার ও সেনাবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করছে বলেও দাবি করেন তিনি। তিনি বলেন, আইসিসির হস্তক্ষেপ মিয়ানমার ও সেনাবাহিনীর মর্যাদার ক্ষতি করছে।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর বেশকিছু স্থাপনায় ‘বিদ্রোহীদের’ হামলার পর রোহিঙ্গাদের গ্রামে গ্রামে শুরু হয় সেনাবাহিনীর অভিযান। সেই সঙ্গে শুরু হয় বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে রোহিঙ্গার ঢল। গত এক বছরে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের কথায় উঠে এসেছে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াওয়ের ভয়াবহ বিবরণ। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা মিয়ানমার বাহিনীর ওই অভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে বর্ণনা করে আসছে। জাতিসংঘ গঠিত স্বাধীন আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন বলেছে, রাখাইনে যে ধরনের অপরাধ হয়েছে, আর যেভাবে তা ঘটানো হয়েছে, এর মাত্রা, ধরন ও বিস্তৃতি গণহত্যার সমতুল্য।

সর্বশেষ খবর