বুধবার, ৩ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

ফের আলোচনায় কিশোর গ্যাং

ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তরুণরা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধের ধরন ও ভয়াবহতার মাত্রা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে

মাহবুব মমতাজী

আবারও আলোচনায় কিশোর গ্যাং। এবার রাজধানীর হাজারীবাগে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে জীবন দিল প্রতিপক্ষ গ্যাংয়ের আরেক সদস্য। তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, হাজারীবাগ, ধানমন্ডিসহ আশপাশ এলাকায় আলোচনায় এসেছে কিশোর গ্যাংয়ের নৃশংসতার বিষয়টি।

রাজধানীসহ সারা দেশেই ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোর ও উঠতি বয়সী তরুণরা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অপরাধের ধরন ও ভয়াবহতার মাত্রা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে। এই কিশোর-তরুণরা আগে ছোটখাটো অপরাধ করলেও এখন হরহামেশা হত্যা ও ধর্ষণের মতো বড় অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। কখনো তুচ্ছ ঘটনায় বাবা-মা, সহপাঠী-বন্ধুদেরও খুন করতে দ্বিধা করছে না তারা। এর বাইরে এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন গ্যাংয়ের হয়ে আধিপত্য বিস্তারসহ ভাড়ায় খুনোখুনিতে কিশোরদের জড়িত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের শিথিলতা, সন্তানকে সময় না দেওয়া, সঙ্গদোষ, সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়, স্বল্প বয়সে স্মার্টফোনসহ উন্নত প্রযুক্তির নাগাল পাওয়া, প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত অর্থ পাওয়া, বাছবিচার ছাড়া সন্তানদের আবদার পূরণ, অপরাধ করেও শাস্তি না পাওয়াসহ যথাযথ পর্যবেক্ষণের অভাবে কিশোর ও উঠতি বয়সের তরুণরা  ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এর আগে গত বছর রাজধানীর উত্তরায় স্কুলছাত্র আদনান কবির হত্যার মধ্য দিয়ে দেশব্যাপী আলোচনায় আসে কিশোর গ্যাংয়ের কথা। ওই বছরের ৬ জানুয়ারি আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষ গ্রুপের সদস্যদের হামলায় গুরুতর আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় স্কুলছাত্র আদনান। এবার একইভাবে হাজারীবাগে ইয়াসিন আরাফাত নামে এক কিশোরকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় আবারও ছড়িয়ে পড়েছে কিশোর গ্যাং আতঙ্ক। ২৯ জুন রাত পৌনে ১২টার দিকে হাজারীবাগে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হয় ইয়াসিন। পরে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ সময় পুলিশ জানায়, এলাকার কিশোর ‘গ্যাংয়ের’ সঙ্গে দ্বন্দ্বের জের ধরে এই হত্যাকা- ঘটেছে। জানা যায়, হাজারীবাগ থানার টালি অফিস এলাকার জরিনা শিকদার স্কুলের সামনের রাস্তায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে খুন হয় ইয়াসিন আরাফাত। নিহত ইয়াসিন কিশোর গ্যাং ‘লাভলেট’ গ্রুপের সক্রিয় সদস্য ছিল। সাত দিন আগে ‘বাংলা’ গ্রুপ নামের প্রতিপক্ষ দলের প্রধান সৈকতকে মারধর করেছিল ‘লাভলেট’ গ্রুপের সদস্যরা। আর এর প্রতিশোধ হিসেবে ইয়াসিনের ওপর হামলা চালায় বাংলা গ্রুপ। এ বিষয়ে হাজারীবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইকরাম আলী মিয়া এ প্রতিবেদককে জানান, ইয়াসিন খুনে ১০ জনকে আটক করা হয়েছে। প্রত্যেকের বয়স ১৮ বছরের নিচে। এ খুনের নেপথ্যে ছিল কিশোর গ্যাংয়ের দ্বন্দ্ব। খুনে ব্যবহৃত চাকুগুলোও উদ্ধার করা হয়েছে। এই দুই গ্রুপের সদস্যরা কেউই স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করে না। আর এ হত্যাকান্ডে যারা জড়িত, এদের বেশির ভাগই বিভিন্ন ধরনের কাজ করে। একেক গ্রুপে সদস্যসংখ্যা ৫০-৬০ জনের বেশি।

চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর শ্যামপুরে মৃত্যুর পর এক নবজাতকের লাশ মাটি দেওয়া হয়। ওই লাশ মাটিচাপা থেকে উঠিয়ে মাথা বিচ্ছিন্ন করে ছয় কিশোর-তরুণ। ঘটনার পর রুদ্র (১৮), সুভঙ্কর চন্দ্র রায় (১৫), বিপুল দাস (১৪), রনক দে (১৩) ও বিজয় দে (১৫) নামে পাঁচজনকে আটক করে পুলিশ। এ ঘটনায় শুভ (২২) নামে এক তরুণ পলাতক রয়েছে বলে জানা গেছে। শ্যামপুর থানা সূত্রে জানা গেছে, তান্ত্রিক সাধনা করতে গিয়ে ওই কিশোর-তরুণরা নবজাতকের লাশ তুলে মাথা বিচ্ছিন্ন করার মতো বর্বর কাজ করে বলে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে।

সিলেটের গোয়াইনঘাটে প্রেমিকাকে নিয়ে ঘুরতে গিয়ে চা-বাগানের ভিতর আপত্তিকর অবস্থায় ধরা পড়ে তরুণ আবরাবুল হক (১৯)। স্থানীয় সোয়াব আলী, কালা মিয়াসহ কয়েকজন বিষয়টি দেখে ফেলে আবরাবুলের পরিবারকে ডেকে আনেন। এ ঘটনায় আবরাবুলের পরিবার ছেলেকে শাসিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ আবরাবুল প্রতিশোধ নিতে কালা মিয়ার ছয় বছরের শিশুসন্তান সোহেলকে গলা কেটে হত্যা শেষে লাশ জঙ্গলে ফেলে দেয়। ৬ ফেব্রুয়ারি গোয়াইনঘাট উপজেলার ফেনাইকোনা এলাকায় এ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। ২১ এপ্রিল শবেবরাতের রাতে একটি গ্যাংয়ের হাতে ছুরিকাঘাতে নিহত হয় কুমিল্লার মডার্ন স্কুলের ছাত্র মোমতাহিন হাসান মিরন। এর আগে ১৬ এপ্রিল কুমিল্লা জিলা স্কুলের ছাত্র মারুফ ও কালেক্টরেট স্কুলের ছাত্র তৌকি গ্যাংয়ের সদস্যদের হাতে ছুরিকাঘাতে আহত হয়। ২০১০ সালে রাজধানীর কিশোরসন্ত্রাসীদের ৫১৬ জনের একটি তালিকা তৈরি করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। ওই তালিকায় ওয়ারী অঞ্চলে ১৪৪, মিরপুর অঞ্চলে ১০৬, মতিঝিল অঞ্চলে ৭৫, রমনা অঞ্চলে ৫১, লালবাগ অঞ্চলে ৩৬, তেজগাঁও অঞ্চলে ৪৬, গুলশান অঞ্চলে ৪৮ ও উত্তরা অঞ্চলে ১০ কিশোর অপরাধীকে চিহ্নিত করা হয়।

২০১৫ সালের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৯০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত কিশোর অপরাধের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। ১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত রাজধানী ঢাকায় কিশোর অপরাধের মোট মামলা ছিল ৩ হাজার ৫০১টি। কিন্তু পরবর্তী ১০ বছরে, অর্থাৎ ২০০০ থেকে ২০১০ পর্যন্ত মামলার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৮৮২টি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, কিশোরদের অপরাধ প্রবণতা বাড়ার সার্বিকভাবে মূলে রয়েছে মূল্যবোধের অবক্ষয়। কারণ এখন সমাজে তেমন কোনো রোল মডেল নেই। এ জন্য তারা কার কাছে কী শিখবে সেই মানুষ খুঁজে পায় না। তাই সর্বক্ষেত্রে অপরাধ ছড়িয়ে পড়েছে। এ ছাড়া কিশোরদের বিভিন্ন মহল অপব্যবহার করে থাকে। আর তাদের মধ্যে এক ধরনের দুঃসাহসিকতা কাজ করে, যে কারণে তারা একটু হিরোইজম দেখাতে চায়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর