শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

বাজেটের প্রভাব বাজারে

বেড়েছে রড সিমেন্টসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম, হতাশা সাধারণ মানুষের

মানিক মুনতাসির, ঢাকা ও ফারুক তাহের, চট্টগ্রাম

বাজেটের প্রভাব বাজারে

জাতীয় সংসদে সদ্য পাস হওয়া ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট বাস্তবায়নের শুরুতেই রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ সারা দেশের বাজারে প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্য ও নির্মাণসামগ্রী রড-সিমেন্টের দাম বাড়তে শুরু করেছে। আর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে জনজীবনে। এতে হতাশা প্রকাশ করেছে সাধারণ মানুষ। এর ফলে নিজেদের বাজেট মেলাতে হিমশিম খাচ্ছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের লোকজন। এবারের বাজেটে নতুন ভ্যাট আইনের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। ফলে অর্থবছরের শুরুতে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। খাদ্যপণ্যের ট্যারিফ মূল্য বিলুপ্ত করে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে। এজন্য প্রায় সব ধরনের খাদ্যপণ্যের দামও বাড়তে শুরু করেছে। অন্যদিকে রড-সিমেন্টের দাম বাড়ায় নির্মাণ ব্যয় বাড়তে শুরু করেছে। এর ফলে ফ্ল্যাটের দামও বাড়বে। এমনকি এর প্রভাবে বাসা ভাড়াও বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন আবাসন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা। বাজেটের এই প্রভাবে বছরান্তে প্রতি টন রডের দাম বাড়বে প্রায় ১১ হাজার টাকা। ইতিমধ্যে প্রতি টন রড়ের দাম ১ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা বেড়েছে। আর প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম বেড়েছে কমপক্ষে ৫০ টাকা। রড-সিমেন্টের দাম বাড়ায় সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয়ও বাড়বে।

এ প্রসঙ্গে ক্রাউন সিমেন্ট গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুদ খান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাজেটে ভ্যাট, ট্যাক্স বাড়ায় আমাদের প্রতি বস্তা সিমেন্টের উৎপাদন খরচ বেড়েছে ৫৩ টাকা। ফলে বাধ্য হয়ে গ্রাহক পর্যায়ে আমরা ইতিমধ্যে ৫০ টাকা দাম বাড়িয়েছি। বাজেট পাসের আগে প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম ছিল ৪৬৮ টাকা। এখন এর দাম দাঁড়িয়েছে ৫১৮ টাকা। বাজেট পাসের আগে এটা বিবেচনার জন্য আমরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছিলাম। এ শিল্পের কথা চিন্তা করে শিগগিরই আমরা আবারও বিবেচনার জন্য সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে দাবি জানাব।’

অন্যদিকে বিএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাজেট পাসের পরদিন থেকেই রডের দাম বেড়েছে। এতে এ খাতে অস্থিরতা নেমে এসেছে। আমরা সর্বস্তরের মানুষের কথা চিন্তা করে এই বাড়তি ভ্যাট, ট্যাক্স বিবেচনার জন্য সরকারের সঙ্গে বসতে চাই। অন্যথায় এ খাতসহ পুরো আবাসন খাতে বিপর্যয় নেমে আসবে।’ এ ছাড়া সরাসরি বাড়ানো হয়েছে মোবাইলে কথা বলার খরচ। মোবাইলে ফোনে কথা বলার ক্ষেত্রে প্রতি ১০০ টাকার ২৭ টাকাই চলে যাচ্ছে সরকারের কোষাগারে যা আগে ছিল ২২ টাকা। এতে মোবাইল ফোনে কথা বলার খরচ বেড়েছে। একইভাবে বেড়েছে মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচও। মোবাইল কলরেটের সঙ্গে স্মার্টফোনের ওপর বাড়তি কর আরোপ করা হয়েছে। এর প্রভাবে ইতিমধ্যে মোবাইল ফোন সেটের দামও বেড়েছে। এদিকে সরকারি ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান টিসিবির হিসাবেও ৩০ জুন বাজেট পাসের পর নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। চাল, আলু, পিয়াজ, গুঁড়া দুধ, রসুনসহ প্রায় সব ধরনের মাছের দাম বেড়েছে। টিসিবির ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, বাজেট পাসের পর আমদানি করা ডানো ও ডিপ্লোমা ব্র্যান্ডের প্রতি কেজি গুঁড়া দুধের দাম বেড়েছে ২০ টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া ফ্রেশ ও মার্কস গুঁড়া দুধের দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ টাকা। ডিমের দাম প্রতি ডজনে বেড়েছে ১০ থেকে ২০ টাকা। তবে টিসিবির ওয়েবসাইটে গতকালও রডের দাম আগের মতোই প্রতি টন ৬২ থেকে ৬৭ হাজার ও ৫৬ থেকে ৫৮ হাজার টাকা প্রদর্শিত হয়েছে। যদিও ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সারা দেশের বাজারে বাস্তবে দাম বেড়েছে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে আমদানি করা ও দেশি উভয় ধরনের ডালের দামও কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। চিনি আমদানিতেও বাজেটে বাড়তি শুল্ক আরোপ করা হয়েছে, যার প্রভাবে চিনির দামও বাড়তে শুরু করেছে।

ব্যাংক কর্মকর্তা সাইফুল্লাহ মানসুর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বাজেটের পর যে হারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, আবার এর সঙ্গে যুক্ত হতে যাচ্ছে গ্যাসের বাড়তি দাম; তাতে নিজের বাজেট মেলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। নতুন এ বাজেটে সাধারণ মানুষের জন্য তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়নি, বরং ধনী ও বণিক শ্রেণির মানুষদের বেশি সুবিধা দেওয়া হয়েছে।’ বন্দরনগরী চট্টগ্রামের বাজারেও সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে বাজেট পাসের পর। এবারের বাজেটে আমদানি পর্যায়ে প্রায় ৪ হাজার পণ্যের ওপর কর বৃদ্ধি করা হয়েছে। আর এ ৪ হাজার পণ্যের বেশির ভাগই নিত্যপ্রয়োজনীয়, যা নিম্নমধ্যবিত্তরা ব্যবহার করেন। চট্টগ্রামে তিন দিনের ব্যবধানে অনেক নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে রড, সিমেন্ট, পার্টিকেল বোর্ড, সিগারেট, গুল, জর্দা, মধু, মোটরসাইকেল, মোবাইল ফোন, ওভেন, বিভিন্ন ধরনের কুকার, কুকিং প্লেট, গ্রিলার, রোস্টারের মতো কম প্রচলিত পণ্যের দামও। সরেজমিন গিয়ে জানা যায়, তিন দিনের ব্যবধানে চট্টগ্রামের বাজারে দেশে উৎপাদিত সিমেন্টের দাম বস্তাপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ টাকা বেড়েছে। এর আগে কখনো এ হারে সিমেন্টর দাম বাড়েনি বলে জানান সাধারণ ক্রেতা ও বিক্রেতারা। তবে সিমেন্ট কারখানার মালিকরা বলছেন, বাজেটে সিমেন্টের ওপর বিভিন্ন ধরনের শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। ফলে তারাও বাধ্য হয়ে বাজেটে বর্ধিত শুল্ক সমন্বয় করেছেন মাত্র। জানা গেছে, গত অর্থবছরে আমদানি ও স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা লোহার স্ক্র্যাপ থেকে তৈরি এমএস রড ও অ্যাঙ্গেল তৈরিতে প্রতি টনে স্তরভেদে ৪৫০ থেকে ৫৪০ ও ৯০০ টাকা ভ্যাট ছিল। কিন্তু এবারের বাজেটে প্রতি টন রডে স্তরভেদে ভ্যাট ১ হাজার, ১ হাজার ২০০ ও ২ হাজার টাকা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে রিহ্যাব চট্টগ্রাম অংশের চেয়ারম্যান আবদুল কইয়ুম চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এমনিতেই আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা সুবিধাজনক অবস্থানে নেই, তার ওপর রড-সিমেন্টের দাম বেড়ে যাওয়ায় নির্মাণ ব্যয় বেড়ে যাবে। ফলে ফ্ল্যাটের দাম বেড়ে গেলে সামগ্রিক আবাসন ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।’ এদিকে চট্টগ্রামে পাইকারি ও খুচরা বাজারে গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে নিত্যয়োজনীয় অনেক পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। চালের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি ৪ থেকে ৫ টাকা, আটা ১ টাকা, আলু ৪ দশমিক ৬০ টাকা, পিয়াজ ৩ টাকা, রসুন (দেশি) ৪০ টাকা, আদা ২৫ টাকা, চিনি ২ দশমিক ২০ টাকা। এ ছাড়া চা-পাতা কেজিপ্রতি ৬০ থেকে ৮০ টাকা, গুঁড়া দুধ ১০০ টাকা, ডিটারজেন্ট পাউডার কেজিপ্রতি ২০ টাকা বেড়ে গেছে। এর বাইরে সয়াবিন তেল, পাম অয়েল, সানফ্লাওয়ার তেল, সরিষার তেলের আমদানি পর্যায়ের ওপর মূসক আরোপ করা হয়েছে। তবে খুচরা বাজারে এখনো ভোজ্যতেলের দাম অপরিবর্তিত থাকলেও কয়েক দিনের মধ্যে সব ধরনের ভোজ্যতেলের দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান খুচরা বিক্রেতারা।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর