শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

পর্যটননগরী পাতায়ার বাণিজ্যে ১৭০ বাংলাদেশি

বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণীয় এ শহরে ব্যবসা-বাণিজ্য সাজিয়ে বসেছেন বাংলাদেশিরা। ছবির মতো সাজানো গোছানো নগরে প্রায় ১৭০ জন বাংলাদেশি আছেন। সবাই উদ্যোক্তা ব্যবসায়ী। নিজেরা মিলে একটি কমিউনিটিও গড়ে তুলেছেন। থাই-বাংলাদেশি কমিউনিটি, পাতায়া।

রুকনুজ্জামান অঞ্জন, পাতায়া (থাইল্যান্ড) থেকে ফিরে

পর্যটননগরী পাতায়ার বাণিজ্যে ১৭০ বাংলাদেশি

থাইল্যান্ডের ‘স্বর্গরাজ্য’ পাতায়া বিচের কাছেই ওয়েলকাম প্লাজা হোটেল। এক থেকে দেড় হাজার বাথে এখানে থাকা যায় বলে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের পর্যটকরা এই হোটেলটিতে ওঠেন। এক বাথ বাংলাদেশি প্রায় পৌনে তিন টাকার কাছাকাছি। সাউথ টাউনের ওয়েলকাম প্লাজা থেকে বেরোলেই হাতের ডানপাশে যে  রেস্টুরেন্ট তার কাচের দেয়ালে বাংলায় লেখা, ‘এখানে বাংলাদেশি খাবার পাওয়া যায়’। এই রেস্টুরেন্টের মালিকের নাম রাসেল। ঢাকার বাসিন্দা রাসেল থাইল্যান্ডের পাতায়ায় গিয়ে প্রথমে টেইলার্সের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। সেই ব্যবসা পরিবর্তন করে এখন রেস্টুরেন্টের ব্যবসা শুরু করেছেন। রাসেলের হোটেল থেকে নাইট বাজারের দিকে এগোতেই আরও একটি বাংলাদেশি খাবারের হোটেল দেখা গেল। এর মালিকও বাংলাদেশি। ঢাকার ছেলে রানাও প্রথমে টেইলার্সের ব্যবসা শুরু করেন। তিনিও এখন রেস্টুরেন্ট ব্যবসা শুরু করেছেন।

বিশ্বের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন শহর পাতায়ায় এভাবেই ব্যবসা-বাণিজ্য সাজিয়ে বসেছেন বাংলাদেশিরা। ছবির মতো সাজানো গোছানো শহরটিতে প্রায় ১৭০ জন বাংলাদেশি আছেন। তারা কেউ চাকরি করেন না। সবাই উদ্যোক্তা ব্যবসায়ী। নিজেরা মিলে একটি কমিউনিটিও গড়ে তুলেছেন। থাই-বাংলাদেশি কমিউনিটি, পাতায়া। এই কমিউনিটির জেনারেল সেক্রেটারি নাজীর আহমেদ সরকার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, মূলত ৯০ দশক থেকে সেখানে কিছু বাংলাদেশি টেইলার্সের ব্যবসা শুরু করেন। তারপর ধীরে ধীরে সেই সংখ্যাটি বাড়তে বাড়তে ২০০-এর কাছাকাছি পৌঁছায়। দশ বছর আগেও রাশিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের ভিড়ে মুখরিত থাকত পাতায়ার আনাচ-কানাচ। ইউরোপের চেয়ে সস্তা বলে তারা সেখান থেকে স্যুট কিনে নিতে পছন্দ করত। আর এই স্যুট বানানোর জন্য বাংলাদেশিদের সুনাম ছিল। সেই সুবাদে পাতায়ায় বাংলাদেশিদের ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু। তবে বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক মন্দা অন্যান্য ব্যবসার মতো থাইল্যান্ডের পর্যটনেও আঘাত হেনেছে। ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে রাশিয়ান পর্যটক কমতে থাকে। আর ব্রেক্সিট ইস্যুর পর থেকে কমতে থাকে ব্রিটেনের পর্যটক। যে পাতায়ায় আগে ইউরোপের পর্যটকদের ভিড় ছিল, এখন সেখানে বাড়ছে ভারতীয় ও বাংলাদেশিদের পদচারণা। উপমহাদেশীয় পর্যটকদের ভিড় বাড়ায় বদলে গেছে ব্যবসার ধরনও। পর্যটকদের চাহিদা অনুযায়ী এখন বাংলাদেশিরা মূলত পাতায়ায় ট্যুরিজম, রেস্টুরেন্ট, ট্রাভেল এজেন্সি, গেস্ট হাউস, এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট, রেডিমেড গার্মেন্ট- এসব ব্যবসায় ঝুঁকছেন। নাজীর আহমেদ জানালেন, তিনি নিজেও ট্যুরিজম ব্যবসায় যুক্ত। বিয়ে করেছেন থাই নারীকে। তার স্ত্রীর রয়েছে বুটিকের দোকান। এক ছেলে পাতায়ার একটি ইংলিশ মিডিয়াম মুসলিম স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়ে। তিনি বলেন, ভারতীয় ও বাংলাদেশিরা দেশীয় খাবার খেতে পছন্দ করেন। এ কারণে এখানে সাব-কন্টিনেন্টাল ফুডের রেস্টুরেন্ট বাড়ছে। মধ্যপ্রাচ্যের পর্যটকরাও এ ধরনের স্পাইসি খাবার পছন্দ করেন। এ ছাড়া দলবেঁধে ঘুরতে আসা উপমহাদেশের পর্যটকরা কম খরচে থাকা-খাওয়া ও ঘুরতে পছন্দ করেন। এ সুযোগটি তারা সহজেই করে দিতে পারেন।

প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কর্মঠ ও বিশ্বাসী হওয়ায় থাইল্যান্ডের মানুষের কাছে বাংলাদেশিদের সুনাম রয়েছে। বাংলাদেশিদের অনেকেই থাই মেয়েদের বিয়ে করে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ নিচ্ছেন বলে জানালেন থাই-বাংলাদেশি কমিউনিটির সহসভাপতি গিয়াসউদ্দিন ও মেহেদী হাসান। থাই মেয়েরা বাংলাদেশি মুসলিমকে বিয়ে করে মুসলিম হতে আপত্তি করে না। ওদের পরিবার থেকেও তেমন বাধা আসে না।

বাংলাদেশিরা কীভাবে সেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন-এমন প্রশ্নের জবাবে কমিউনিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জামান শামীম বলেন, থাইল্যান্ডে বিদেশিদের ওয়ার্ক পারমিটে কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। সে কারণে সম্ভাবনা থাকার পরও দেশটিতে বাংলাদেশির পরিমাণ হাতে গোনা। এখানে কমপক্ষে ২০ লাখ বাথ বিনিয়োগ করে কোম্পানি খুললে ব্যবসা পরিচালনার জন্য দুজনের অবস্থান ও কাজ করার অনুমতি মেলে। বিনিয়োগের পরিমাণ এর দ্বিগুণ হলে ওয়ার্ক পারমিটের সংখ্যাও দ্বিগুণ হয়। অবৈধভাবে অবস্থান ও কাজের সুযোগ নেই এখানে। কীভাবে নাগরিকত্ব পাওয়া যায়-এমন প্রশ্নে কমিউনিটির আরেক যুগ্ম সম্পাদক আনিসুজ্জামান বলেন, থাইল্যান্ডে নাগরিকত্ব পাওয়ার বিষয়টি সহজ নয়। তবে বিজনেস ভিসায় অনেক দিন থাকা যায়। কোনো সমস্যা হয় না।

পাতায়ায় বসবাসরত বাংলাদেশিদের অভিযোগ প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় অ্যাম্বাসিতে প্রবাসীদের জন্য পৃথক ডেস্ক খোলার ঘোষণা দিলেও সেখানে গিয়ে কোনো কর্মকর্তাকে পাওয়া যায় না সমস্যা সমাধানের জন্য। কমিউনিটির এক নেতা জানান, তিনি তার মেয়ের পাসপোর্টে নাম পরিবর্তনের জন্য কয়েক বছর ধরে ঘুরছেন, কিন্তু সমাধান পাচ্ছেন না। আরেকজন জানালেন, থাইল্যান্ডে জন্ম নেওয়ার কারণে তিনি তার সন্তানের জন্য পাসপোর্ট পাচ্ছেন না। অথচ উত্তরাধিকার সূত্রে তার সন্তান বাংলাদেশি। এত গেল অ্যাম্বাসির ঝামেলা। বাংলাদেশে আসতে চাইলে ঝামেলা শুরু হয় এয়ারপোর্ট থেকে। নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ইমিগ্রেশন পার হওয়ার পর প্রবাসীদের অতিরিক্ত টাকা খরচ করতে হয় পদে পদে। জমি রেজিস্ট্রেশন থেকে সন্তানের জন্মনিবন্ধন সব কাজেই টাকা। প্রবাসী বলে অনেকে বলে-কয়েই টাকা দাবি করেন। অনেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে গিয়েও পড়েছেন নানা ঝামেলায়। একজন জানালেন, পরিবারসহ তিনি পাতায়ায় থাকায় কয়েক বছর আগে বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য যে জায়গাটি কিনেছিলেন, সেটি এখন আরেকজন দখল করে তার বিরুদ্ধে উল্টো মামলা ঠুকে দিয়েছে। পৃথিবীর সুন্দরতম পর্যটননগরী পাতায়ার একটি বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টে মাথা নিচু করে বসে থাকা প্রবাসীদের প্রশ্ন, এসব মামলা-হয়রানি আর উটকো ঝামেলা থেকে প্রবাসী বাংলাদেশিদের কি রেহাই নেই?

সর্বশেষ খবর