শনিবার, ৬ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

ডায়াগনস্টিক টেস্টে নয়ছয়

নজরদারি নেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের, নেই নির্ধারিত মূল্য তালিকা, যার যা খুশি তাই করে, পরীক্ষা-নিরীক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন, কমিশনে ব্যস্ত চিকিৎসকরা, অসহায় রোগী

শামীম আহমেদ ও জয়শ্রী ভাদুড়ী

ডায়াগনস্টিক টেস্টে নয়ছয়

স্বাস্থ্য পরীক্ষায় সরকার নির্ধারিত মূল্য তালিকা না থাকায় ইচ্ছামতো ফি নিচ্ছে হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো। দামের পার্থক্যের পাশাপাশি মান নিয়েও রয়েছে যথেষ্ট অভিযোগ। নিজস্ব ল্যাবরেটরি না থাকলেও নমুনা সংগ্রহ করে অন্য প্যাথলজিতে টেস্ট করিয়ে রিপোর্ট সরবরাহ করা হচ্ছে। ভুল আর অসঙ্গতিতে ভরা রিপোর্টে দেশের স্বাস্থ্যসেবার প্রতি আস্থা হারাচ্ছে মানুষ। বাংলাদেশ একাডেমিক অব প্যাথলজিস্ট বলছে, রোগ নির্ণয়ে কোন পরীক্ষার জন্য রোগীদের কত টাকা দিতে হবে এটা কখনো নির্ধারণ করা হয়নি। এ বিষয়ে কোনো সরকারি নির্দেশনাও নেই। ফলে রোগীদের কাছ থেকে খরচের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি টাকা নিচ্ছে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক। অভিযোগ রয়েছে, চিকিৎসকদের রেফারেন্সে রোগীরা আসছে এসব নামসর্বস্ব ক্লিনিকে। অনেক সময় দালালদের মাধ্যমেও সরকারি হাসপাতাল থেকে টেস্টের জন্য রোগী নিয়ে আসা হচ্ছে এসব ক্লিনিকে। রেফারেন্সের ফলে এসব ক্লিনিক থেকে কমিশন ঢুকছে রেফারেন্স প্রদানকারী চিকিৎসকের পকেটে। এই কমিশনের বাড়তি টাকা আদায় করা হচ্ছে রোগীদের কাছ থেকে। নামসর্বস্ব ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করায় দেশের চিকিৎসাসেবার প্রতি সাধারণ মানুষের তৈরি হচ্ছে আস্থাহীনতা। সেবা পেতে ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর পাড়ি জমাচ্ছে মানুষ। নিজস্ব ল্যাবরেটরি না থাকলেও নমুনা সংগ্রহ করে অন্য প্যাথলজিতে টেস্ট করিয়ে রিপোর্ট সরবরাহ করা হচ্ছে রোগীদের। অনেক সময় নমুনা অন্যত্র নিয়ে যাওয়ায় হারাচ্ছে গুণগত মান।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, স্বাস্থ্য পরীক্ষায় মূল্য তালিকা প্রদর্শনের পাশাপাশি  মূল্য নির্ধারণও জরুরি। কোন যন্ত্র ব্যবহার করলে মূল্য কত আসবে সেটাও তদারকি করতে হবে। নয়তো রোগীদের ঠকানোর নতুন পন্থা বের করবে নামসর্বস্ব ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো। রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফি নিয়ে রীতিমতো নৈরাজ্য চলছে। স্বাস্থ্যসেবা পরিণত হয়েছে লাভজনক ব্যবসায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিবিসি টেস্টের জন্য নেওয়া হয় ১৫০ টাকা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) নেওয়া হয় ২০০ টাকা, বারডেমে ৩০০ টাকা, ইউনাইটেড হাসপাতালে ৫৫০ টাকা, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের মতিঝিল শাখায় ৪০০ টাকা, ল্যাবএইড মিরপুর শাখায় ৫৫০ টাকা, সেন্ট্রাল হাসপাতালে ৪৫০ টাকা, গ্রিন ভিউ ক্লিনিকে ৪০০ টাকা, গ্রিন লাইফ হাসপাতালে ৫০০ টাকা এবং আইসিডিডিআর’বিতে ৮৪০ টাকা নেওয়া হয়। মূত্র পরীক্ষার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় ২০ টাকা, বিএসএমএমইউতে নেওয়া হয় ১০০ টাকা, বারডেমে নেওয়া হয় ১৫০ টাকা, ল্যাবএইডে নেওয়া হয় ৩০০ টাকা, ইউনাইটেডে নেওয়া হয় ৩৫০ টাকা এবং আইসিডিডিআর’বিতে মূত্রের সিএস টেস্টের জন্য নেওয়া হয় ১ হাজার ৬৮০ টাকা। মল পরীক্ষার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় ২০ টাকা, বিএসএমএমইউতে নেওয়া হয় ১০০ টাকা, বারডেমে নেওয়া হয় ১৫০ টাকা, ল্যাবএইডে নেওয়া হয় ২৫০ টাকা, ইউনাইটেডে নেওয়া হয় ৩৫০ টাকা, আইসিডিডিআর’বিতে নেওয়া হয় ৯৫০ টাকা। ক্রিয়েটিনিন টেস্টের জন্য ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয় ৫০ টাকা, বিএসএমএমইউতে ৭০ টাকা, বারডেমে নেওয়া হয় ২০০ টাকা, ল্যাবএইডে নেওয়া হয় ৩০০ টাকা, ইউনাইটেডে নেওয়া হয় ৫২০ টাকা, আইসিডিডিআর’বিতে নেওয়া হয় ৩৭০ টাকা।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আল্ট্রাসনোগ্রাফি অব অ্যাবডোমেনে খরচ হয় ১১০ টাকা, বিএসএমএমইউতে ২৫০ টাকা, বারডেমে ১০০০ টাকা, ল্যাবএইডে ২০০০ টাকা, আইসিডিডিআর’বিতে ২২০০ টাকা, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল মতিঝিল শাখায় ১০৩০ টাকা, সেন্ট্রাল হাসপাতালে ১২০০ টাকা, গ্রিন ভিউ ক্লিনিকে ১৫০০ টাকা, গ্রিন লাইফ হাসপাতালে ১৬০০ টাকা নেওয়া হয়। অধিকাংশ টেস্টে দামে এমন আকাশ-পাতাল পার্থক্য থাকলেও উদাসীন কর্তৃপক্ষ।

সরকারি হাসপাতালে রক্তের একটি নমুনা পরীক্ষা করানোর খরচ ১৫০ টাকা। অথচ একই পরীক্ষা বেসরকারি ক্লিনিক কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে করাতে তিন থেকে চারগুণ বেশি খরচ হচ্ছে। অধিকাংশ পরীক্ষায়ই রাখা হচ্ছে এরকম মূল্য। হাসপাতাল ও ক্লিনিকে প্যাথলজি টেস্টের মূল্য তালিকা প্রদর্শনের নির্দেশনা রয়েছে। সরকারি হাসপাতাল ও কিছু প্রাইভেট ক্লিনিক-হাসপাতাল মূল্য তালিকা টানালেও অধিকাংশ ক্লিনিকেই তা নেই। এর ফলে টেস্ট করাতে গিয়ে আগে দাম যাচাইয়ের সুযোগ থাকছে না রোগীর। ফলে বাড়ছে দেশের চিকিৎসা ব্যয়।

সর্বশেষ ২০১৭ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যয় হিসাবের তথ্যে দেখা যায়, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে রোগীর নিজস্ব ব্যয় সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৭ শতাংশ রোগী নিজের পকেট থেকে খরচ করে। বাংলাদেশের কাছাকাছি খরচ হয় আফগানিস্তানে, সেখানে ৬৪ শতাংশ।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্যাথলজি সেবার মূল্যমান নির্ধারণ করা অত্যন্ত জরুরি। স্বাস্থ্য খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে আইন তৈরির খসড়া দীর্ঘদিন ধরে চলমান। এ খাতে অরাজকতা আছে, যুদ্ধ আছে কিন্তু অবমুক্তি নেই।’

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর