শনিবার, ১৩ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

বালুচরে গহিন বনাঞ্চল

অরণ্যে ঢুকলে যে-কারও গা ছমছম করবেই পাওয়া যাবে রোমাঞ্চকর এক অনুভূতিও

নিজস্ব প্রতিবেদক, রাজশাহী

বালুচরে গহিন বনাঞ্চল

নানা প্রজাতির গাছ। গাছে জড়িয়ে আছে লতাপাতা। আর মাটিতে শুয়ে বড় বড় হরেক রকমের ঘাস। এর ভিতর দিয়ে হেঁটে গেলে কানে আসবে পাখির কিচিরমিচির, শেয়ালের ডাক। হঠাৎ দু-একটি সাপও পড়তে পারে দৃষ্টিতে। তাই এ অরণ্যে ঢুকলে যে-কারও গা ছমছম করবেই। কিন্তু রোমাঞ্চকর এক অনুভূতি পাওয়া যাবে সেটাও নিশ্চিত। মিটবে গহিন অরণ্য দেখার স্বাদও। রাজশাহী জেলা সদর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে গোদাগাড়ী উপজেলার ফরাদপুর গ্রাম-সংলগ্ন পদ্মা নদীর চরে সরকারি উদ্যোগে এ বনভূমি গড়ে তোলা হয়েছে। পুরো জেলার ভিতরে এত বড় বনভূমি আর নেই। বন তৈরিতে ফরাদপুর গ্রামের ২৪৯ জনকে  করা হয়েছে উপকারভোগী। তাদের সহযোগিতায় বালুচরেই গড়ে উঠেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক লীলাভূমি। ফরাদপুর গ্রামের উত্তর পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে পদ্মা নদী। কয়েক বছর আগে এখানে পদ্মা নদী বিভক্ত হয়ে পড়ে দুই ভাগে। তখন নদীর বেশির ভাগ অংশই চলে যায় ভারতের ভিতরে। নদীর দুই অংশের মাঝের অংশটি ভারত ও বাংলাদেশের সীমানা-সংলগ্ন। জায়গাটি তুলনামূলক উঁচু। ভরা মৌসুমে নদীর দুই অংশ পানিতে টইটম্বুর হয়ে গেলেও উঁচু এ স্থানটি ডোবাতে পারে না পদ্মার পানি। ফলে সেখানে বাবলা এবং এ-জাতীয় কিছু গাছ আপনা-আপনি জন্মে বড় হতে থাকে। ঘন কাশবন আর ঝোপঝাড়েও ভরে যায় পুরো এলাকা। ফরাদপুরের গ্রামবাসী সেসব ঝোপঝাড় কেটে পরিষ্কার করে বালুমাটিতেই ফসলের চাষাবাদ শুরু করেন। কিন্তু কিছু বাবলা গাছ বড় হতেই থাকে। বন বিভাগ দেখল, বিস্তীর্ণ এ জমিটিতে বনভূমি গড়ে তুললে মন্দ হয় না। সেই ভাবনা থেকেই ২০১১-১২ অর্থবছরে বিভাগীয় সামাজিক বন বিভাগ এ বনভূমি গড়ে তোলে। সাত বছরে সত্যিকার অর্থেই সেটি এখন রূপ নিয়েছে গহিন অরণ্যে। গোদাগাড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম জানান, যখন এ বনভূমিটির কাজ শুরু হয়েছিল, তখন মনেই হয়নি বালুচরে এমন বনভূমি গড়ে উঠবে। এখন তো এ বনভূমি বিশাল অরণ্যে পরিণত হয়েছে। এটি যাতে আরও বাড়ানো যায়, সেজন্য তারাও পদক্ষেপ নিচ্ছেন বলে জানান। বনভূমিটি ৯০ হেক্টরেরও বেশি জমিজুড়ে বিস্তৃত। ‘সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন’ প্রকল্পের আওতায় শুরুতে এখানে বৃক্ষরোপণেই ১ কোটি ৫ লাখ ৮৪ হাজার টাকা খরচ করে বন বিভাগ। গ্রামের ২৪৯ জনকে উপকারভোগী করে রোপণ করা হয় খয়ের, শিশু, বাবলাসহ বিভিন্ন প্রজাতির ১ লাখ ৩২ হাজার গাছ। এসব গাছ এখন ডালপালা মেলেছে। সেখানে বাসা বেঁধেছে পাখিরা। শীতকালে এ বনে বিপুলসংখ্যক অতিথি পাখি আসে। সারা দিন পদ্মার বিস্তীর্ণ চরে খাবারের সন্ধান করে। রাতে আশ্রয় নেয় বনে। অবৈধভাবে পাচারের সময় বিভিন্ন স্থানে উদ্ধার হওয়া পাখিগুলোকেও এ বনে অবমুক্ত করা হয়। গ্রামের ভিতর ধরা পড়া মেছোবাঘও অবমুক্ত করা হয়েছে এখানে। এ ছাড়া পদ্মার চরেই এ বন হওয়ায় আছে প্রচুর শেয়াল ও সাপ। সাপদের মধ্যে আছে বিশ্বের অন্যতম বিষধর ‘রাসেল ভাইপার’ বা ‘চন্দ্রবোড়া’। তাই অরণ্য দেখতে গেলে জুতা পরে যাওয়াই ভালো।

ফরাদপুর পৌঁছানোর পর গ্রামের যে কোনো স্থান থেকে সোজা উত্তর দিকে চলে গেলেই পাওয়া যাবে পদ্মা নদী। গ্রামের পাশ দিয়েই চলে গেছে নদীটি। এটি নদীর একটি অংশ। নদীর বড় অংশটি ভারতের ভিতরে। শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের এ অংশে পানি থাকে না। তবে গ্রাম থেকে নেমে প্রায় ৫০০ মিটার হাঁটার পর খুবই ছোট্ট একটা নদী পাওয়া যাবে। শুষ্ক মৌসুমে বড়জোর হাঁটুসমান পানি হতে পারে। নদীর প্রস্থ হতে পারে ২০০ মিটার বা তারও কম। যেখানে এ নদী শেষ সেখানেই বনভূমির শুরু। নদীর কোলে পাহাড়ের মতো উঁচু ভূমিতেই গড়ে উঠেছে এ বন। বনের ভিতর কোথাও ঝোপঝাড়ে পূর্ণ। আবার কোথাও স্যাঁতসেঁতে মাটি। এর ভিতর দিয়ে হেঁটে গেলে গা ছমছম করবেই। তার ভিতরেও মাঝেমধ্যে দেখা মিলবে পাতাকুড়ানিদের দল। আর বনের দুই পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে উপভোগ করা যাবে নির্মল বাতাস। নদীর পাড় থেকে উত্তর দিকে প্রায় এক কিলোমিটার হাঁটার পর বনভূমি শেষ হবে। তারপর পাওয়া যাবে ঝাউবন, কাশবন। এর ভিতরই পাওয়া যাবে ভারত-বাংলাদেশের সীমানা পিলার। পিলারের ওপাশ ভারত। এপাশ বাংলাদেশ। কাঁটাতারের কোনো বেড়া নেই। অরণ্য দেখতে গিয়ে কেউ কেউ দু-এক ধাপ ভারতের মাটিতেও রেখে আসেন। বন বিভাগের কয়েকজন কর্মী সারা দিন বন পাহারায় থাকেন। বনের ভিতর তাদের সব পথ চেনা। বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আহমদ নিয়ামুর রহমান জানান, পরিকল্পিত বনায়নের অংশ হিসেবে গোদাগাড়ীর বালুচরে বনাঞ্চলটি গড়ে তোলা হয়েছে। সেটি যাতে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য বন বিভাগের বিশেষ নজরদারিও আছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর