রবিবার, ১৪ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

পানির ঢলে ভোগান্তি সারা দেশে

নিজস্ব প্রতিবেদক

পানির ঢলে ভোগান্তি সারা দেশে

লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় বাড়িঘরে উঠেছে বন্যার পানি। গতকাল তোলা ছবি -বাংলাদেশ প্রতিদিন

টানা বর্ষণ ও উজান থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে দেশের প্রায় সব নদ-নদীর পানি বেড়েই চলেছে। অন্তত ১২টি নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর মধ্যে উত্তরবঙ্গের তিস্তা, ধরলা, ব্রহ্মপুত্রের অবস্থা সবচেয়ে বিপজ্জনক। তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি স্লুইস গেটের সবকটি খুলে দিয়ে পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। কর্মকর্তারা বলছেন, ভারতে অভিন্ন নদ-নদীর উৎসের কাছে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় এগুলোর পানি আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, গাইবান্ধাসহ উত্তরের জেলাগুলোর লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছে। মৌলভীবাজারে মনু নদ ও ধলাই নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সাঙ্গু নদ এবং বাঁকখালী ও মাতামুহুরী নদীর পানি বেড়ে পার্বত্য জেলা বান্দরবানের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। সিলেটে বাড়ছে সুরমা ও কুশিয়ারার পানি। জামালপুরে যমুনার পানি বিপদসীমার ৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ১০ হাজারের বেশি মানুষ। গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদ এবং তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। নেত্রকোনায় পাহাড়ি ঢলে উদ্বাখালী নদী ও কংস নদতীরবর্তী অসংখ্য গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

উজানের পাহাড়ি ঢলে তিস্তা ব্যারাজের ফ্লাট বাইপাসে ছুঁইছুঁই পানি। ব্যারাজ রক্ষার্থে যে কোনো মুহূর্তে ফ্লাট বাইপাস কেটে দেওয়া হতে পারে বলে মনে করছেন পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তারা। এদিকে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার গড্ডিমারী, বড়খাতা শহরের সঙ্গে একমাত্র পাকা সড়কটি গতকাল দুপুরে পানির তোড়ে ভেঙে যোগাযোগ-বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। গতকাল দুপুরে তিস্তার পানিপ্রবাহ দোয়ানি পয়েন্টে বিপদসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। তিস্তা ব্যারাজের ডালিয়া পয়েন্টে ছিল ৫৩.০৫ সেন্টিমিটার। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী হাফিজুর রহমান জানান, ‘শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে তিস্তা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করায় ব্যারাজ এলাকা ও ফ্লাট বাইপাসের উজানে পানি উন্নয়ন বোর্ড রেড অ্যালার্ট জারি ও নদীতীরবর্তী লোকজনকে নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য মাইকিং করেছে।’ ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি পরিমাপক উপসহকারী প্রকৌশলী আমিনুর রশিদ জানান, উজানের ঢল সামাল দিতে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি স্লুইস গেটের (জলকপাট) সবই খুলে রাখা হয়েছে। তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপরে চলে যাওয়ায় বিভিন্ন স্থানের বাঁধ হুমকির মুখে পড়েছে। শ্রেণিকক্ষ ডুবে যাওয়ায় লালমনিরহাটের ৩৯টি বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। সারা দেশ থেকে প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর- রংপুর : তিস্তার পানি বেড়ে রংপুরের তিন উপজেলার নয়টি ইউনিয়নের দুর্গম চরাঞ্চলের ৪০টি গ্রাম হাঁটু থেকে কোমরপানিতে তলিয়ে গেছে। এতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। গঙ্গাচড়া ও কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপদসীমার ৫৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বাড়ায় চরাঞ্চলের শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৪৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী মমতাজ উদ্দিন জানান, গঙ্গাচড়া উপজেলার নোহলী, কচুয়া, আলমবিদিতর, গঙ্গাচড়া সদর এবং কাউনিয়া উপজেলার টেপামধুপুর, সদর ও পীরগাছা উপজেলার ছাওলা এবং তাম্বুলপুর ইউনিয়নের তিস্তাতীরবর্তী গ্রামগুলো তলিয়ে গেছে। রবিশস্যসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সিলেট : সিলেটে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। গতকাল নতুন করে জেলার ছয় উপজেলার নিম্নাঞ্চলের অনেক এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বন্যাক্রান্ত উপজেলাগুলোয় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ পাঠানো হয়েছে। পাউবো জানিয়েছে, সিলেটের সুরমা, কুশিয়ারাসহ সবকটি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় জেলার গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, বালাগঞ্জ ও ফেঞ্চুগঞ্জে নতুন করে বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বন্যায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ। গোয়াইনঘাট-সারিঘাট, গোয়াইনঘাট-সালুটিকর, হাতিরপাড়া-ফতেহপুর সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় গোয়াইনঘাট উপজেলা শহরের সঙ্গে ওই এলাকার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সুনামগঞ্জ : সুনামগঞ্জের সদর, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, দোয়ারাবাজার, ছাতক, জামালগঞ্জ ও ধর্মপাশা উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। সুরমা নদীর পানি প্রবেশ করেছে জেলা শহরের কয়েকটি এলাকায়। পানিবন্দী হয়ে দুর্ভোগে রয়েছে জেলার বন্যাকবলিত এলাকার লক্ষাধিক মানুষ। গতকালও সুরমার পানি বিপদসীমার ৮৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বন্যার কারণে জেলার ২২৮টি প্রাথমিক ও প্রায় ৫০টি মাধ্যমিক স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। জামালপুর : জামালপুরে গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি ৬৯ সেন্টিমিটার বেড়ে বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৫৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ইসলামপুর উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের ১৫টি গ্রামের অন্তত ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। উপজেলার চিনাডুলী ইউনিয়নের চিনাডুলী, শিংভাঙ্গা, বাবনা, পূর্ববাবনা, দেওয়ানপাড়া, কড়ইতলা, ডেবরাইপ্যাচ, নন্দনের পাড়, বেলগাছা ইউনিয়নের মুন্নিয়ারচর, চরবড়–, শিলদহ, সিন্দুরতলী ও কুলকান্দি ইউনিয়নের বেড়কুশা, জিগাতলা, চরকুলকান্দি গ্রামের ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। মৌলভীবাজার : মৌলভীবাজারের মনু নদ ও ধলাই নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ধলাইয়ের বাঁধ ভেঙে কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। শুক্রবার রাত থেকে কমলগগঞ্জ উপজেলার রামপাশা, ঘোড়ামারা, রহিমপুরে প্লাবন দেখা দেয়। তবে গতকাল বিকালে ধলাইর পানি বিপদসীমার নিচে নামায় প্লাবিত এলাকা থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। মনুর পানি বাড়ার ফলে প্রতিরক্ষা বাঁধের ভিতরের বাসিন্দাদের বাড়িঘর প্লাবিত হয়েছে। মৌলভীবাজার শহরাংশে সৈয়ারপুর, গোজারাই এলাকায় কয়েক শতাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। গাইবান্ধা : গাইবান্ধায় বিপদসীমা অতিক্রম করেছে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও ঘাঘট। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, গতকাল ব্রহ্মপুত্র বিপদসীমার ৪২ সেন্টিমিটার, তিস্তা ১২ সেন্টিমিটার ও ঘাঘট নদ বিপদসীমার ১৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বিপদসীমর নিচে থাকলেও করতোয়া নদীর পানিও বৃদ্ধি পেয়েছে।

পানি বৃদ্ধির ফলে জেলা সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এসব অঞ্চলের অন্তত ২০টি গ্রাম পানিতে ডুবে গেছে। ফলে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। রাস্তাঘাট তলিয়ে গিয়ে যোগাযোগব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফসলি জমি ডুবে গেছে। নীলফামারী : নীলফামারীর ডালিয়ায় বিকাল ৩টায় বিপদসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে তিস্তার পানি। পানিবন্দী হয়ে রয়েছে ডিমলা উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের ১০ হাজার মানুষ। ডুবে গেছে নদীবেষ্টিত আশপাশ এলাকা ও চরসমূহ। নিম্নাঞ্চলের মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয় নিতে শুরু করেছে উঁচু স্থানে।

বগুড়া : বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে যমুনার পানি বিপদসীমার ৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। চর এলাকার কামারপুর, রহদহ, ঘুঘুদহ, চন্দনবাইশা, ধলিরকান্দি ও কুতুবপুরের নিচু এলাকা ডুবে গেছে। পানির নিচে তলিয়ে গেছে আউশ ধান, আমন বীজতলা ও শাকসবজির খেত। বগুড়া জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহমেদ জানান, বন্যার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে সংশ্লিষ্ট সব বিভাগকে নিয়ে সভা করে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ত্রাণসামগ্রীও প্রস্তুত রয়েছে। বান্দরবান : বান্দরবানে ভারি বর্ষণ অব্যাহত রয়েছে। গত দুই দিনে বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ১৩১ মিলিমিটার। সাঙ্গু নদ এবং মাতামুহুরী ও বাঁকখালী নদীর পানি বিপদসীমার কয়েক ফুট ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। প্লাবিত হয়েছে নতুন নতুন এলাকা। পাহাড়ধসের কারণে রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানছি উপজেলায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। জনপ্রশাসন, সেনাবাহিনী ও পৌরসভার পক্ষ থেকে আশ্রয় শিবিরগুলোয় শুকনো খাবার ও খিচুড়ি দেওয়া হলেও তা অপ্রতুল। খাগড়ছড়ি : খাগড়াছড়িতে চেঙ্গী, মাঈনী ও ফেনী নদীর পানি কমতে থাকায় বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে বিভিন্ন অফিস, স্কুল, মাদ্রাসা, বসতবাড়ি ও ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। এখানকার নদী তিনটি খরস্রোতা হওয়ায় টানা কয়েক ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই পাহাড়ি ঢলে নিচু এলাকার নদীতীরবর্তী গ্রামগুলো ডুবে যায়। বৃষ্টি কয়েক ঘণ্টার জন্য থামলেই নদীগুলোর স্রোতে ভাঙন সৃষ্টি হয়। নেত্রকোনা : নেত্রকোনার উদ্বাখালী নদ ও কংস নদতীরবর্তী বেশ কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পাশাপাশি কলমাকান্দা উপজেলার হাওর এলাকা বড় খাপন ইউনিয়নের বেশ কিছু গ্রামে পানি প্রবেশ করেছে।

ফুলবাড়ী : কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে নীলকমল নদ এবং ধরলা ও বারোমাসিয়া নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব নদ-নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কায় উপজেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট এলাকার চেয়ারম্যানদের উদ্যোগে মাইকিং করে লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। প্লাবিত এলাকায় গোখাদ্য ও বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাব দেখা দিয়েছে। উপজেলা প্রশাসন বন্যাদুর্গতদের জন্য জরুরি ভিত্তিতে ২০০ প্যাকেট শুকনা খাবার ৩ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ করেছে। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় উপজেলা সদরে উপজেলা ভূমি অফিস ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বর তলিয়ে গেছে।

সর্বশেষ খবর