রবিবার, ১৪ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইন এখনো খসড়া

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে

আরাফাত মুন্না

সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির ঘটনা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। কর্মস্থলেও যৌন হয়রানির অভিযোগ শোনা যায় মাঝেমধ্যে। অভিযোগ দেওয়ার সঠিক জায়গা খুঁজে না পেয়ে অনেকেই অনাকাক্সিক্ষত এ ঘটনা চেপে যাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ প্রতিবাদ করলেও নানাভাবে হেনস্তার শিকার হন। তীব্র মানসিক যন্ত্রণা সইতে না পেরে মৃত্যুকে বেছে নেন অনেকে। অথচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ৯ বছর আগে একটি আইনের খসড়া করে দিয়েছিল আইন কমিশন, যেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কর্মস্থলে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা অনুসারে অভিযোগ কমিটি গঠনেরও বিধান রাখা হয়েছিল। নির্ধারণ করা হয়েছে যৌন হয়রানির সংজ্ঞাও। লঘু ও গুরু অপরাধ আলাদাভাবে চিহ্নিত করে একটি তফসিল সংযুক্ত করা হয় খসড়া আইনে। হাই কোর্টের এক রায়ে দেওয়া নীতিমালার আলোকে তৈরি করা আইনটি এখনো খসড়াই রয়ে গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার তৎপর না হলে যৌন হয়রানি কমবে না। তাই দ্রুত এমন একটি আইন করার উদ্যোগ নিতে হবে। জানা গেছে, ২০০৯ সালে হাই কোর্টের দেওয়া রায়ে সংসদকে আইন প্রণয়নের জন্য বলা হয়। এরপর ২০১০ সালের ২৫ আগস্ট আইন কমিশন যৌন হয়রানি প্রতিরোধে একটি খসড়া আইন তৈরি করে। ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইন, ২০১০ (প্রস্তাবিত খসড়া)’ নামের আইনটিতে মোট ২১টি ধারা রয়েছে। এ ছাড়া লঘু ও গুরু অপরাধ আলাদাভাবে চিহ্নিত করে একটি তফসিল সংযুক্ত করা হয়। সর্বশেষ গত বছর সেপ্টেম্বরে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতিসহ ১৭টি সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ‘জেন্ডার প্ল্যাটফর্ম’ এ আইনের বিষয়ে মতামত এবং আইনের একটি খসড়া অনুলিপি আইন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। এ ছাড়া কয়েকটি নারী সংগঠনও এ-সংক্রান্ত খসড়া উপস্থাপন করেছে। সংগঠনগুলো যৌন হয়রানি রোধে এখন আইন তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করছে। জানতে চাইলে আইন কমিশনের মুখ্য গবেষণা কর্মকর্তা (জেলা জজ) ফউজুল আজিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের কাজ আইনের খসড়া তৈরি করা, আইন করা নয়। হাই কোর্টের রায়ের আলোকে আমরা খসড়া তৈরি করে দিয়েছি। আইনটি পাস করার বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের।’ এ বিষয়ে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট ফেওজিয়া করিম ফিরোজ বলেন, ২০০৯ সালে যৌন হয়রানি রোধে যে রায় হাই কোর্ট দেয়, তার সব বিবাদী সরকারের মন্ত্রণালয়গুলো। সরকারের সচিবদের ওপর নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিল। কিন্তু তারা সেটা করছে না। এ কারণে যৌন হয়রানি বেড়েই চলেছে। তিনি বলেন, ‘যেহেতু এ নীতিমালা কার্যকর হয়নি, তাই একটা আইন করতে আমরা তৎপর। এ আইনের একটা খসড়া করেছি। সেটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। এ বিষয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে। আইন করা নিয়ে আলোচনা চলছে।’

অভিযোগ কমিটি : খসড়া আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠলে তা খতিয়ে দেখতে কর্তৃপক্ষকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে বলা হয়েছে। আইনে এ কমিটিকে ‘অভিযোগ কমিটি’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কর্মস্থলে শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী, কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ৫০ জনের বেশি হলে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট এবং ৫০ জনের কম হলে তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। সম্ভাব্য ক্ষেত্রে কমিটির প্রধান ও অধিকাংশ সদস্য নারী রাখতে বলা হয়েছে খসড়া আইনে।

খসড়া অনুযায়ী যৌন হয়রানি : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ আইনের খসড়ার ২(ট) ধারায় যৌন হয়রানির সংজ্ঞা তুলে ধরা হয়। ওই ধারা অনুসারে, যৌন হয়রানি বলতে বোঝায়, অনাকাক্সিক্ষত যৌন আবেদনমূলক আচরণ (সরাসরি কিংবা ইঙ্গিতে); যেমন শারীরিক স্পর্শ বা এ ধরনের প্রচেষ্টা, প্রাতিষ্ঠানিক এবং পেশাগত ক্ষমতা ব্যবহার করে কারও সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা, যৌন হয়রানি বা নিপীড়নমূলক উক্তি, যৌন সুযোগ লাভের জন্য অবৈধ আবেদন, পর্নোগ্রাফি দেখানো, যৌন আবেদনমূলক মন্তব্য বা ভঙ্গি, অশালীন ভঙ্গি, অশালীন ভাষা বা মন্তব্যের মাধ্যমে উত্ত্যক্ত করা। এ ছাড়া কাউকে অনুসরণ করা বা অশালীন উদ্দেশ্য পূরণে ব্যক্তির অলক্ষ্যে তার নিকটবর্তী হওয়া বা অনুসরণ, যৌন ইঙ্গিতমূলক ভাষা ব্যবহার করে ঠাট্টা বা উপহাস, চিঠি, টেলিফোন, মোবাইল, এসএমএস, ছবি, নোটিস, কার্টুন, বেঞ্চ, চেয়ার-টেবিল, নোটিস বোর্ড, অফিস, ফ্যাক্টরি, শ্রেণিকক্ষ, বাথরুমের দেয়ালে যৌন ইঙ্গিতমূলক অপমানজনক কোনো কিছু লেখা, ব্ল্যাকমেইল অথবা চরিত্র লঙ্ঘনের উদ্দেশ্যে স্থির বা ভিডিওচিত্র ধারণ, যৌন হয়রানির কারণে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং শিক্ষাগত কার্যক্রমে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হওয়া, প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়ে হুমকি দেওয়া বা চাপ প্রয়োগ করা, ভয় দেখিয়ে বা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বা প্রতারণার মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক স্থাপন বা স্থাপনের চেষ্টা করাও যৌন হয়রানি বলে গণ্য হবে।

সর্বশেষ খবর