উজান থেকে আসা অভিন্ন নদীর পানির ঢল আর বৃষ্টির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় দেশের নদ-নদীগুলো ফুঁসে উঠেছে। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বিস্তীর্ণ জনপদ বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। অনেক এলাকায় ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। তলিয়ে গেছে ফসলের জমি ও বসতি। দ্রুত বাড়ছে যমুনা, তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি। একইভাবে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, সোমেশ্বরীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। এ কারণে এসব অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব, দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন ভারতের সিকিম, পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চল, আসাম ও মেঘালয়ে ভারি বৃষ্টি হচ্ছে। এজন্য দেশের সব নদ-নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ কারণে আগামী তিন দিন বা ৭২ ঘণ্টায় প্রধান নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। একই সময় চট্টগ্রাম, সিলেট ও রংপুর বিভাগে সুরমা, কুশিয়ারা, কংস, সোমেশ্বরী, ফেনী, হালদা, মাতামুহুরী, সাঙ্গু, ধরলাসহ প্রধান নদীগুলোর পানি আরও বাড়তে পারে। একই কারণে নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। গতকাল দুপুর পর্যন্ত যমুনা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্রসহ দেশের ১৫টি নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। কুড়িগ্রামে ধরলা-ব্রহ্মপুত্র পাড়ে নতুন করে পানিবন্দী ২ লাখেরও বেশি মানুষ। যমুনার পানি বেড়ে জামালপুরে প্লাবিত হয়েছে ৪০ গ্রামের প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ। নতুন করে প্লাবিত হয়েছে শেরপুরে ঝিনাইগাতী, নালিতাবাড়ী ও নকলার ৫৫টি গ্রামও। লালমনিরহাটে তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপরে থাকলেও বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। গাইবান্ধায় চার উপজেলার বেশির ভাগ চরাঞ্চল ডুবেছে। পানিবন্দী হয়েছে অন্তত ২০ হাজার মানুষ। নেত্রকোনায় সোমেশ্বরীর পানি অপরিবর্তিত থাকলেও বেড়েছে কংসের পানি। নতুন করে জলমগ্ন প্রায় তিন ইউনিয়ন। সিলেটেও তিন উপজেলার নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকেছে। খাগড়াছড়ির মেরুং-লংগদু সড়কের বড় মেরুং ছড়ার ওপর থাকা বেইলি সেতুটি ৬ দিন ধরে পানিতে তলিয়ে আছে। বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার মথুরাপাড়া পয়েন্টে যমুনার পানি বিপদসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে দুটি উপজেলা সোনাতলা ও সারিয়াকান্দির নিম্নাঞ্চলের ৮০টি গ্রামের মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছে। ভারি বৃষ্টিপাতে বান্দরবানে আরও অবনতি হয়েছে বন্যা পরিস্থিতির। ঘণ্টায় ঘণ্টায় নতুন নতুন এলাকা বন্যার পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। কক্সবাজারের চকরিয়া-পেকুয়ায় ভয়াবহ বন্যায় ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর- লালমনিরহাট : লালমনিরহাটে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। গতকাল তিস্তার পানি দোয়ানি পয়েন্টে কমে বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ও ধরলার পানি কুলাঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে পানিবন্দী মানুষগুলোর মাঝে দেখা দিয়েছে ত্রাণ সংকট। অনাহারে-অর্ধাহারে রয়েছে পানিবন্দী জেলার অর্ধ-লক্ষাধিক মানুষ। জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, বানভাসি মানুষের জন্য বরাদ্দ রয়েছে মাত্র দেড়শ টন চাল। যা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য। কয়েক দিনে ভারি বর্ষণ ও উজানের ঢলে তিস্তা ও ধরলার প্রবল স্রোতে ভেঙে গেছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩টি বাঁধ ও পাকা সড়ক। বাঁধ ভেঙে আরও ৮টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। বন্ধ রয়েছে ৩৯ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে ধরলা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্রসহ সবকটি নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি বিপদসীমার ৭৯ সেন্টিমিটার, চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি ৭৫ সেন্টিমিটার ও নুনখাওয়া পয়েন্টে ৩৯ সেন্টিমিটার এবং কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তার পানি ২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে জেলার ৯ উপজেলার ৪ শতাধিক চরও দ্বীপচরসহ নদ-নদীর তীরবর্তী এলাকার প্রায় দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে দেখা দিয়েছে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। এলাকার কাঁচা-পাকা সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। বগুড়া : বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলায় যমুনার পানি ২০ সেন্টিমিটার বেড়ে গতকাল সকালে বিপদসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনা নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পূর্বদিকের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। সারিয়াকান্দি উপজেলার মথুরাপাড়া পয়েন্টে যমুনার পানি বিপদসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে দুটি উপজেলা সোনাতলা ও সারিয়াকান্দির নিম্নাঞ্চলের ৮০টি গ্রামের মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েছে। জেলা প্রশাসকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখার ত্রাণ কর্মকর্তা আজাহার আলী ম ল জানান, যমুনা নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বিপরীতে পূর্বদিকে জেলার সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলায় বন্যার পানিতে ৫৬৮ হেক্টর কৃষিজমি প্লাবিত হয়েছে। দুই উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের ৮০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৪ হাজার ৬০টি পরিবারের ৫৭ হাজার ২৮০ লোক। ৬০টি কাঁচা ঘর পানিতে তলিয়ে গেছে। সোনাতলা ও সারিয়াকন্দি উপজেলার ২৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বান্দরবান : পাহাড়ি ঢল নামছে সাঙ্গু আর মাতামুহুরী নদীতে। এই নদীর পানি দুই কূল ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে নিম্ন এলাকায়। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভারি বৃষ্টিপাত। এতে বান্দরবানে আরও অবনতি হয়েছে বন্যা পরিস্থিতির। ঘণ্টায় ঘণ্টায় নতুন নতুন এলাকা বন্যার পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। পাহাড়ধসে বিকল্প সড়ক হিসেবে ব্যবহৃত বান্দরবান-রাঙামাটি সড়কও বন্ধ হয়ে গেছে। এদিকে টানা ষষ্ঠ দিনের মতো বান্দরবান জেলা শহরের সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। বান্দরবান-কেরানীহাট সড়কের বাজালিয়া বড়দুয়ারা অংশের রাস্তা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জে যমুুনার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। পানি বৃদ্ধির কারণে চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। প্রায় দুই শতাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। শত শত বিঘা ফসলি জমি ইতিমধ্যে পানিতে তলিয়ে গেছে। রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় চলাচলেও দুর্ভোগ শুরু হয়েছে। অন্যদিকে পানি বৃদ্ধির কারণে কাজিপুর, এনায়েতপুর ও চৌহালী উপজেলায় কয়েকটি পয়েন্টে ভাঙন শুরু হয়েছে। জামালপুর : যমুনার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জামালপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে যমুনার পানি ৫৪ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৮৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে জামালপুরের চার উপজেলার অন্তত ৭০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। নেত্রকোনা : নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে নেত্রকোনার নিম্নাঞ্চলীয় বিভিন্ন সড়ক। তবে সোমেশ্বরীর, কংস ও ধনু নদীর পানি কিছুটা কমলেও এখনো বিপদসীমার ২৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে কলমাকান্দার উব্দাখালী নদীর পানি। এতে নতুন করে ঠাকুরোকোনা কলমাকান্দা সংযোগ সড়কটি তলিয়ে গেছে। গাইবান্ধা : গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্রের পানি ৪১ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৮৩ সেন্টিমিটার, তিস্তার পানি ৮ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার এবং ঘাঘট নদীর পানি ৪০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৫৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। বিপদসীমার নিচে থাকলেও করতোয়া নদীর পানি ১৮ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। জেলার সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার প্রায় ৪৪ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। পানিবন্দী মানুষের জন্য ৬৩টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। কক্সবাজার : পাহাড়ি ঢলে চকরিয়া-পেকুয়ায় বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ ১৭টি অভ্যন্তরীণ সড়কের ওপর দিয়ে পাহাড়ি ঢলের পানি প্রবাহিত হওয়ায় যান চলাচল বিঘিœত হচ্ছে। দুই উপজেলায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ৫ লাখ মানুষ। ঢলের পানিতে তলিয়ে অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। পানি প্রবেশ করায় শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অঘোষিত বন্ধ রয়েছে।
মৌলভীবাজার : মৌলভীবাজারের কুশিয়ারা, মনু ও ধলাই নদের পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদী ভাঙন ও বাঁধ উপচে পানি প্রবেশ করে জেলার কমলগঞ্জ ও সদর উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। এতে কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। গতকাল বিকাল পর্যন্ত মনুর পানি বিপদসীমার ৪৩ সেমি ওপর, ধলাই ৩৪ সেমি ও কুশিয়ারা ৫০ সেমির ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
হবিগঞ্জ : হবিগঞ্জে কালনী কুশিয়ারা-ভেড়ামোহনা ও খোয়াই নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।গতকাল বিকাল পর্যন্ত কুশিয়ারা নদীর পানি হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ অংশে বিপদসীমার ৪৮ সেন্টিমিটার, খোয়াই নদীর পানি বাল্লা সীমান্তে ১৬৪ সেন্টিমিটার, মাছুলিয়া পয়েন্টে ১১০ সেন্টিমিটার বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ব্রাহ্মণবাড়িয়া : ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি ঢল ও ভারি বর্ষণের পানির তোড়ে আখাউড়ার সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল সকালে হাওড়া নদীর বাঁধ ভেঙে নিচু এলাকার ৬টি গ্রামের বাড়িঘরে পানি উঠেছে। গাছপালা ও রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিসহ বিভিন্ন পুকুরের মাছ পানিতে ভেসে গেছে। এ ছাড়াও স্থলবন্দরের নিচু এলাকাগুলোতে পানি উঠে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। ভারি বর্ষণে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ব্রা?হ্মণবাড়িয়ার কসবা রেলস্টেশনের কার্যালয়ে পানিতে তলিয়ে গেছে। স্টেশন মাস্টারের কার্যালয়ে রাখা অব্যবহৃত টিকিট, জেনারেটর, ব্যাটারিসহ আসবাবপত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কসবা উপজেলার ব্রা?হ্মণগ্রাম রেলসেতু এলাকায় রেললাইন থেকে মাটি সরে যাওয়ায় ঝুঁকি নিয়ে ট্রেন চলাচল করছে।