মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

কমছেই না জামিন জালিয়াতি

উচ্চ আদালতে মাদক মামলার আসামিরাই বেশি কাণ্ড ঘটায়, জড়িত অসাধু আইনজীবী ক্লার্ক ও সুপ্রিম কোর্টের কর্মকর্তারা, পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলার নির্দেশ

আরাফাত মুন্না

কমছেই না জামিন জালিয়াতি

দেশের সর্বোচ্চ আদালতে জামিন জালিয়াতির ঘটনা কমছেই না। ভুয়া নথি দাখিল বা হাই কোর্টের জাল জামিন আদেশ তৈরি করে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে আসামিরা। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, জামিন জালিয়াতির মামলায় জড়িতদের শাস্তি না হওয়ায় এবং বিচারিক দীর্ঘসূত্রতার কারণে অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাওয়ায় এমন কাণ্ড থামছে না। জানা গেছে, আসামিরা জামিন নেওয়ার ক্ষেত্রে মামলার ভুয়া এফআইআর, চার্জশিট, জব্দ তালিকা দাখিল করছে। অভিযোগের গুরুত্ব কমিয়ে সৃষ্ট জাল কাগজপত্র দেখিয়ে উচ্চ আদালতকে বিভ্রান্ত করে পক্ষে আদেশ নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। এর আগে খোদ সুপ্রিম কোর্টেই ভুয়া জামিন আদেশ তৈরির নজির রয়েছে। এসব জালিয়াতির সঙ্গে কিছু আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্টের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী, মামলার তদবিরকারক ও আইনজীবীর সহকারীরা জড়িত থাকেন। এসব ঘটনা ধরা পড়ার পর বিচারপতিদের নির্দেশে ফৌজদারি মামলাও হচ্ছে। অধিকাংশ জামিন জালিয়াতির ঘটনার সঙ্গে মাদক মামলার আসামিরাই জড়িত রয়েছে বলে অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। গতকালও হাই কোর্টে এমন একটি জামিন জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে। পরে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ নিম্ন আদালতের জাল নথি দাখিল করে জামিন নেওয়া খুলনার তিন আসামি, জামিনের তদবিরকারক ও ঘটনায় জড়িত আইনজীবী সহকারীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে নির্দেশ দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট আদালতের সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল শাহানা পারভিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

মামলা সূত্রে জানা গেছে, ১৭ জুন তিন হাজার পিস ইয়াবা মামলার আসামি রানা বেপারী, তন্বী বেগম ও রানু বেগম হাই কোর্ট থেকে ছয় মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পান। জামিন আবেদনে তাদের কাছ থেকে কোনো ইয়াবা উদ্ধার হয়নি মর্মে বিচারিক আদালতের একটি নথি উপস্থাপন করেন আইনজীবী। পরে গতকাল একই মামলার আরেক আসামি জামিন আবেদন করলে রানা বেপারীদের দাখিল করা জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়ে। এরপর হাই কোর্ট জামিন বাতিলের পাশাপাশি তাদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়। জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিষয়টি দৃশ্যমান না হওয়ায় বারবারই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি বলেন, কিছু কিছু আইনজীবী মিথ্যা তথ্য দিয়ে, তথ্য গোপন করে আসামির জামিন করান। তাদের ব্যাপারে আদালত যদি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ না নেন, সনদ বাতিল বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না করেন, তাহলে এ ধরনের ঘটনা কমবে না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জালিয়াতির মাধ্যমে উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেওয়া দুঃখজনক ঘটনা। কোনো আইনজীবীর এমন জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয় জানতে পারলে আমরা ব্যবস্থা নেব। আর আদালতও যদি অসৎ আইনজীবীদের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়, তাতেও আমাদের কোনো আপত্তি থাকবে না।’ জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ও বিশেষ কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা এখন জাল-জালিয়াতির ঘটনায় বেশ সচেতন বলেই এসব ঘটনা বেশি বেশি ধরা পড়ছে। কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করি।’ সাম্প্রতিক সময়ে বড় দুটি জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে উচ্চ আদালতে। এর মধ্যে ২৭ মে প্রায় সাত লাখ পিস ইয়াবা আটকের মামলায় হাই কোর্টে জাল নথি দাখিল ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে জামিন নেওয়ার চেষ্টা করায় আসামি মো. সালেহ আহমেদ, মামলার দুই তদবিরকারকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের নির্দেশ দিয়েছে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ। ১৯ মে আসামি সালেহ আহমেদের জামিন শুনানিকালে এ জালিয়াতি ধরা পড়ে। অন্যটি হচ্ছে, মাগুরায় একটি জোড়া খুনের মামলার আসামি মোয়াজ্জেম হোসেন জাল নথি দিয়ে হাই কোর্ট থেকে ১৭ এপ্রিল জামিন নেন। বিষয়টি নজরে আসায় বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. রিয়াজ উদ্দিন খানের বেঞ্চ আসামিকে গ্রেফতারের জন্য মাগুরার পুলিশ সুপার ও সদর থানার ওসিকে নির্দেশ দেয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, হাই কোর্টের দুই বিচারপতির স্বাক্ষর জাল করে কারামুক্তি পান ১৮ হাজার পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার মামলার আসামি কক্সবাজারের মো. সাকের। এ ছাড়া সাড়ে ২৯ কেজি সোনা চোরাচালানের মামলায় স্থগিতাদেশ নেন আসামি চট্টগ্রামের আবু আহমেদ। ২০১৬ সালের ১৭ নভেম্বর বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি জাফর আহমেদের বেঞ্চ বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দিলে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন দুটি মামলা করে। এ ঘটনার তদন্ত আজও শেষ হয়নি। গত বছর জুলাইয়ে চট্টগ্রামে ৯০ হাজার পিস ইয়াবাসহ আটক মামলার দুই আসামির জাল জামিন আদেশ তৈরির ঘটনায় হাই কোর্টের ফৌজদারি বিবিধ শাখার ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দায়ী করে প্রতিবেদন দেয় এ-সংক্রান্ত অনুসন্ধান কমিটি। পরে এ ঘটনায় এক কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হয়। মামলায় অন্যদের বিরুদ্ধে চলছে বিচারিক কার্যক্রম। এ ছাড়া গত বছর অক্টোবর মাসে একটি ঘটনার তদন্ত করে ১৭টি জালিয়াতি ধরা পড়েছে। এসব ঘটনার বিচার কবে শেষ হবে সে বিষয়ে কেউ নিশ্চিত নয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর