মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

ধর্ষণ রোধে নেই অ্যাকশন

হাজারে সাজা চারজন ধর্ষকের নেই সরকারি উদ্যোগ

জিন্নাতুন নূর

গণআন্দোলন এবং আইনে অ্যাসিড-সন্ত্রাসে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান কার্যকর করার মাধ্যমে সরকার একসময়ের অ্যাসিড-সন্ত্রাস অনেকটা কমিয়ে আনতে সফল হয়। কিন্তু বর্তমানে দেশব্যাপী ধর্ষণের ভয়াবহতা মহামারী রূপ নিলেও তা রোধে দায়িত্বপ্রাপ্তদের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ বা অ্যাকশনে যেতে দেখা যাচ্ছে না। আদালতে বছরের পর বছর ধরে চলছে ধর্ষণ মামলাগুলোর বিচারকাজ। এ অবস্থায় অপরাধীরা অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে।  আইনজীবীরা বলছেন, ধর্ষণ মামলাগুলো ধামাচাপা দিতে অভিযুক্তরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে আর্থিক লেনদেন করছে। আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি গঠনের জন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। অর্থাৎ ধর্ষণ রোধে কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ডের বিধান থাকা সত্ত্বেও ধর্ষকরা বেপরোয়া। বাংলাদেশে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ৩০০টির মতো ধর্ষণের মামলা করা হচ্ছে। সম্প্রতি জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, দেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে চলতি বছর ৩১ মার্চ পর্যন্ত ১ লাখ ৬৪ হাজার ৫৫১টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে, যার মধ্যে ঢাকায় মামলার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। আর আদালত সূত্রে সারা দেশের আদালতগুলোতে ঝুলে থাকা ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের মামলাগুলোর বার্ষিক নিষ্পত্তির হার মাত্র ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ। এসব মামলায় সাজা পাচ্ছে হাজারে সাড়ে ৪ জন আসামি। আর সরকারিভাবে ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুদের চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার থেকে প্রাপ্ত তথ্যে, ২০০১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এই সেন্টারে চিকিৎসা নিতে আসেন ২২ হাজার ৩৮৬ জন নারী। এর মধ্যে মামলা করা হয় ৫ হাজার ৩টি ঘটনায়। এর মধ্যে ৮০২টি ঘটনায় রায় দেওয়া হয়েছে। আর শাস্তি পেয়েছে ১০১ জন। রায় ঘোষণার হার ৩.৬৬ ভাগ এবং আর সাজার হার ০.৪৫ ভাগ।

হাজারে সাজা হয় মাত্র চারজনের : বেসরকারি সংস্থা নারীপক্ষের এক গবেষণা বলছে, ২০১১ থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত ছয়টি জেলার ধর্ষণের মামলা পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, এই সময়ে ৪ হাজার ৩৭২টি ধর্ষণের মামলা করা হয়। কিন্তু সাজা হয় মাত্র পাঁচজনের।

পর্নো উসকে দিচ্ছে ধর্ষণ : এদিকে পর্নো ছবি ও ভিডিওর প্রসার ধর্ষণের মতো ঘটনা আরও উসকে দিচ্ছে। ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় পর্নো সাইটগুলোতে শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে মধ্যবয়সীদের বিচরণ। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পর্নোগ্রাফি নিয়ে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের স্কুলপড়ুয়া তরুণদের ৭৭ ভাগই পর্নোগ্রাফি দেখে। তারা ইন্টারনেট ছাড়াও মেমোরি কার্ড ও পেনড্রাইভে ২০ থেকে ৩০ টাকার বিনিময়ে পর্নো ভিডিও ডাউনলোড করে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ধর্ষণের ঘটনা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধির পেছনে অশ্লীল ভিডিও দায়ী। সরকারের পক্ষ থেকে বারবার ঘোষণা দেওয়া হলেও সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগ অশ্লীল এই সাইটগুলো পুরোপুরি বন্ধ করতে পারছে না। রাজধানী ছাড়াও এখন বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের পাড়া-মহল্লায় শিশু-কিশোররা মোবাইলে পর্নো ভিডিও সংরক্ষণ করছে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার জানান, পর্নো সাইটগুলো নিয়ন্ত্রণে সরকার কনটেন্ট ফিল্টারিংয়ের কাজ করেছে। এরই মধ্যে ২২ হাজার পর্নো সাইট বন্ধ করা হয়েছে। আরও সাইট বন্ধ করতে কাজ হচ্ছে। অথচ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্যবহারকারীরা বিকল্প ব্রাউজার ব্যবহার করে বন্ধ হয়ে যাওয়া অনেক পর্নোসাইটে প্রবেশ করছে।

নেই সরকারি উদ্যোগ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি ধর্ষণের বিরুদ্ধে পুরুষদের আওয়াজ তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি একই সঙ্গে ধর্ষণ মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি নির্দেশ দেন। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এ ক্ষেত্রে শুধু প্রধানমন্ত্রীর একার সদিচ্ছা যথেষ্ট নয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কেও উদ্যোগী হতে হবে। ২০১৩ সালের ২৬ জানুয়ারি বিচারপতি ইমান আলী ও বিচারপতি শেখ হাসান আরিফের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ এক রায়ে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে দেশের প্রতিটি থানায় আলাদা সেল গঠন করার নির্দেশ দেন। কিন্তু দীর্ঘদিনেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। যৌন হয়রানি প্রতিরোধে উচ্চ আদালত মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর এবং এর আওতাধীন অফিস ও দেশের সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠনের নির্দেশনা দিলেও এ উদ্যোগ এখনো দৃশ্যমান হয়নি। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ধর্ষণ প্রতিরোধে বেশ কিছু জায়গায় সরকারের উদাসীনতা রয়েছে। লক্ষ্য করা যাচ্ছে, আলোচিত ধর্ষণ মামলার আসামিরা কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিকভাবে জড়িত। এমনকি রাজনৈতিকভাবে জড়িত না হলেও তারা কোনো না কোনোভাবে এলাকার প্রভাবশালীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ধর্ষণের ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। এর সঙ্গে আর্থিক লেনদেনও জড়িত।

পার পেয়ে যাচ্ছে অপরাধী : নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনায় কার মামলা মনিটরিং করতে পুলিশ সদর দফতরে পৃথক একটি শাখা আছে। এই শাখার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী কিছু ক্ষেত্রে মামলা চলা অবস্থায় মাঝপথে বাদীপক্ষ আদালতের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। কিছু ক্ষেত্রে গ্রাম্য শালিসে ধর্ষকের সঙ্গে ভিকটিমের বিয়ে বা সামান্য অর্থ দিয়ে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। মূলত সাক্ষীর অভাবেই বেশির ভাগ অভিযুক্ত খালাস পেয়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রামে ধর্ষণের ঘটনাগুলোতে শালিসি বৈঠকের মাধ্যমে যে বিচার হয় আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে তা ধামাচাপা দেওয়ার প্রবণতা দেখা গিয়েছে। আবার সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে যখন ভিকটিমের কাছে তদন্তের জন্য যাওয়া হয়, তখন অভিযুক্তের সঙ্গে তার প্রেমঘটিত সম্পর্ক ছিল কি না এমন প্রশ্ন করে ভিকটিম ও তার পরিবারকে নাস্তানাবুদ করার চেষ্টা করা হয়। এতে ভুক্তভোগী ও তার পরিবার মামলাটি চালিয়ে যেতে নিরুৎসাহিত হন।

দরকার সাক্ষ্য আইনের পরিবর্তন : নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ৯ ধারায় ধর্ষণ অপরাধের জন্য শাস্তি হিসেবে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদ- ও যাবজ্জীবন কারাদ-সহ অর্থদন্ডের বিধান আছে। কিন্তু সাক্ষীর অভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্ষণ মামলাগুলো আলোর মুখ দেখছে না। নারী ও শিশু নির্যাতন-সংক্রান্ত সব অপরাধের বিচারকাজ পরিচালনার জন্য সরকার প্রত্যেক জেলা সদরে একটি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল নামক বিশেষ আদালত গঠন করেছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ধারা ২০(৩) অনুযায়ী ১৮০ দিনের মধ্যে এর বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। অথচ বছরের পর বছর ধরে মামলাগুলোর বিচারকাজ শেষ হয় না। আইনজীবীরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ধর্ষণ সরাসরি প্রমাণিত হলে প্রচলিত আইনে সর্বোচ্চ মৃত্যুদ- ও যাবজ্জীবন শাস্তির যে বিধান আছে তা যথার্থ। তবে ধর্ষণের ক্ষেত্রে সাক্ষ্য আইনের পরিবর্তন করা প্রয়োজন। আমাদের সাক্ষ্য আইনে যেটি নেই তা হলো ভিডিও ও টেপ রেকর্ডার। এগুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর