মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

প্রবাসীদের লাশে বাণিজ্য

মির্জা মেহেদী তমাল

প্রবাসীদের লাশে বাণিজ্য

দেশের লাখ লাখ কর্মী বিদেশে চাকরি করছেন। অনেক সময় কাজ করতে গিয়ে তাদের মারাত্মক দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়। অনেকে এসব ঘটনায় মারা যান। কিন্তু নানা বিড়ম্বনায় দেশে তাদের লাশ আসে না। স্বজনরা দিনের পর দিন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে ঘুরে নিজ খরচেও লাশ আনতে পারছেন না। ফলে মাসের পর মাস লাশ সংশ্লিষ্ট দেশেই পড়ে থাকছে। বৈধ কর্মী হলে লাশ আনা বাবদ সরকারের পক্ষ থেকে ৩০ হাজার টাকা  দেওয়ার বিধান রয়েছে। সেই টাকা পেতেও নানা কাঠ-খড় পোড়াতে হয়। লাশ দেশে আনার পর সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ ৩ লাখ টাকা পরিবারকে দেওয়ার আইন রয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, এই টাকা পেতেও নানা টালবাহানার শিকার হতে হয় স্বজনদের। ক্ষতিপূরণের টাকা পেতেও স্বজনদের টাকা গুনতে হয়। টাকা না দিলে ক্ষতিপূরণের টাকা মেলে না। শুধু তাই নয়, স্বজনদের লাশ ফেরত এনে মন্ত্রণালয় থেকে ৩ লাখ টাকা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যাচ্ছে একটি চক্র। এই প্রতারক চক্র প্রবাসীদের লাশ নিয়ে বাণিজ্য করছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, প্রবাসীদের লাশ বাণিজ্যের একটি চক্র এখন সক্রিয়। এরা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ৮ নং গেটে এসে প্রবাসী শ্রমিকদের লাশ আসার খবর সংগ্রহ করে থাকে। লাশের তালিকা ও ঠিকানা নিয়ে স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকে। তারা প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে ৩ লাখ টাকা পাইয়ে দেওয়ার কাজে সহায়তা প্রদানের আশ্বাস দেয়। আর এ জন্য মোটা অঙ্কের খরচ দাবি করে। প্রবাসীদের স্বজনরা ৩ লাখ টাকা পাওয়ার জন্য এদের কথা মতো ৫০ হাজার বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক লাখ টাকাও দিয়ে থাকে। টাকাগুলো নিয়েই প্রতারক চক্রের সদস্যরা গাঢাকা দেয়। চক্রের সদস্যরা প্রতারণার কাজ ভুয়া সনদপত্রের মাধ্যমে সম্পন্ন করে থাকে। এভাবে একটি চক্র বিদেশে নিহত কর্মীদের স্বজনদের কাছ থেকে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। পথে বসে যাচ্ছে স্বজনরা। এমন অভিযোগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেও অসংখ্য রয়েছে। র‌্যাব নারায়ণগঞ্জ পাইকপাড়া থেকে এমন চক্রের সদস্য সাইদুর রহমানকে গত রবিবার গ্রেফতার করেছে। দীর্ঘ চার বছর ধরে সাইদুর প্রবাসীদের লাশ নিয়ে এভাবে বাণিজ্য করে আসছে। জানা গেছে, বিদেশে মৃত্যুর পর মাসের পর মাস  কেটে গেলেও নানা কারণে ক্ষতিপূরণ পায়নি মৃত অনেকের পরিবার। এক যুগের বেশি সময়ে ৩২ হাজারেরও বেশি প্রবাসী কর্মীর লাশ দেশে এসেছে। কিন্তু এর মধ্যে ১২ হাজারের বেশি পরিবার সরকারি ক্ষতিপূরণ পায়নি। আইনি জটিলতায় কর্মস্থল থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ে দেরি হয় বলে জানিয়েছে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্র। আবার যদি কারও অবৈধ পথে বিদেশে গিয়ে মৃত্যু ঘটে তার দায় মন্ত্রণালয় নেবে না। ওই লাশ স্বজনরা দেশে আনতে মন্ত্রণালয়ের কোনো সহযোগিতা পায় না। ফলে ওই লাশ আর দেশে আসে না। বিদেশে কাজ করতে গিয়ে কর্মীরা বিভিন্ন দুর্ঘটনার শিকার হন হরহামেশায়ই। মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন। সম্প্রতি সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি কর্মী নিহত হন। যারা মারা গেছেন, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নিজ উদ্যোগে তাদের লাশ  দেশে আনার কথা। কিন্তু লাশের স্বজনরা দিনের পর দিন মন্ত্রণালয়ে ঘুরেও তেমন কোন সহযোগিতা পাননি। সূত্র জানিয়েছে, গত দশ বছর আগে সৌদি আরবেই মারা গেছেন ২০ হাজারের বেশি কর্মী। তাদের অনেকের লাশ দেশেই আনা হয়নি। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের গাফিলতি ও দায়িত্বহীনতার কারণে লাশগুলো দেশে আসেনি। স্বজনরা নিজেদের টাকা ব্যয় করে হলেও লাশ দেশে আনার জন্য মন্ত্রণালয়ে বার বার গিয়েও কোনো সহযোগিতা পাননি। বিভিন্ন দেশের কর্মস্থল থেকে ক্ষতিপূরণ  পেতে অপেক্ষা করছে প্রায় ছয় হাজার পরিবার। এরই মধ্যে এসব প্রতারক চক্রের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব হারিয়ে অনেকেই এখন মানবেতর জীবন যাপন করছে। সংশ্লিষ্টরা বলছে, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যুক্ত নেই এমন কারও সঙ্গে এ ব্যাপারে কারও যোগাযোগ করা ঠিক নয়। এতে করে প্রতারণার আশঙ্কা থাকে শতভাগ।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর