মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

বন্যা আক্রান্ত ১৫ জেলায় ছড়াচ্ছে রোগব্যাধি

মৃত্যু বাড়ছে, অসুস্থ অনেক

নিজস্ব প্রতিবেদক

বন্যা আক্রান্ত ১৫ জেলায় ছড়াচ্ছে রোগব্যাধি

বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে মৌলভীবাজারের সৈয়ারপুর এলাকার বন্যার পানি (বাঁমে)। লালমানিরহাটের আদিতমারী উপজেলার চর গোবর্ধন এলাকার একটি বন্যাকবলিত পরিবার -বাংলাদেশ প্রতিদিন

দেশের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও পার্বত্য অঞ্চলের ১৫টি জেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। ১৪টি নদ-নদীর পানি বিভিন্ন পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, আগামী তিন দিনে দেশের প্রধান নদ-নদীর পানি বেড়ে পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। কুড়িগ্রামে ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ৯৯ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ৯৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জামালপুর ও বগুড়ায় যমুনা নদীর পানি বেড়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। জামালপুরের মাদারগঞ্জে বন্যার পানিতে ডুবে সাদিয়া (৭) নামে এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে কয়েক লাখ মানুষ। তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট। ডুবে গেছে সবজিসহ আমনের বীজতলা। ভেসে গেছে হাজার হাজার পুকুরের মাছ। নিরাপদ খাবার পানির অভাবে রয়েছে পানিবন্দী মানুষ। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে শত শত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ভৈরবে মেঘনাসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। মৌলভীবাজারে কুশিয়ারা নদীর পানি বেড়ে ৬টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। যমুনা নদীর পানি গত ২৪ ঘণ্টায় সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে ৩৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গাইবান্ধায় ভেঙে গেছে শহররক্ষা বাঁধ। বন্যাকবলিত মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, আগামী দু-তিন দিন যমুনার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। সারা দেশ থেকে প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর- কুড়িগ্রাম : গত এক সপ্তাহ ধরে কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমর, ফুলকুমরসহ ১৬টি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সরকারি হিসাবেই প্লাবিত হয়ে পড়েছে জেলার ৯ উপজেলার ৫৫ ইউনিয়নের ৩৯০টি গ্রাম। বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে প্রায় ৩ লাখ মানুষ। বন্যাদুর্গত এলাকাগুলোয় শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। এসব এলাকার মানুষজন ঘরবাড়ি ছেড়ে পাশের উঁচু বাঁধ, পাকা সড়কসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নিচ্ছে। অন্যদিকে কুড়িগ্রাম-ভুরুঙ্গামারী মহাসড়ক বিভিন্ন এলাকায় তলিয়ে যাওয়ায় বন্ধ রয়েছে নাগেশ্বরী, ভুরুঙ্গামারী, ফুলবাড়ী উপজেলাসহ সোনাহাট স্থলবন্দরের যোগাযোগব্যবস্থা।

সিরাজগঞ্জ : যমুনার পানি বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় চরাঞ্চলসহ শহরের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পুবপাশের হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। অনেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে রাস্তার ধারে আশ্রয় নিচ্ছে। অনেক পরিবার পানিবন্দী অবস্থায় জীবনযাপন করছে। কৃষক পরিবারগুলো গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে পড়েছে। সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত কোনো সহায়তা পৌঁছেনি পানিবন্দী মানুষের কাছে। ধান-পাটসহ শাকসবজির খেত তলিয়ে যাওয়ায় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া ভাঙনের কারণে অনেকে বসতভিটা-ফসলি জমি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। বগুড়া : ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে আসা ঢলে বগুড়ায় যমুনার পানি বাড়ায় নদীসংলগ্ন সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলায় বন্যার মাত্রা বাড়ছে। গতকাল নতুন করে ১৬টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ নিয়ে ৩ উপজেলার ৯৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সারিয়াকান্দি উপজেলার মথুরাপাড়া পয়েন্টে যমুনার পানি গতকাল বিকালে বিপদসীমার ৭৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। জেলার ৩ উপজেলায় অর্ধলাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। সারিয়াকান্দি উপজেলায় যমুনার বাঁধের পুবপাড়ের বন্যাকবলিত প্রায় ২ হাজার পরিবার বসতভিটা ফেলে আশ্রয় নিয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার ১৪ ইউনিয়নের ৯৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

গাইবান্ধা : গাইবান্ধায় ঘাঘট ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানির তোড়ে গতকাল ভেঙে গেছে চারটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বিভিন্ন অংশ। গাইবান্ধা সদরের ঘাঘট নদের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের খোলাহাটি ইউনিয়নের কুঠারপাড়ায় ৫০ ফুট, গোদারহাট এলাকায় সোনাইল বাঁধের ১০০ ফুট ভেঙে গিয়ে ১৫ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্রের পানির তোড়ে সদর উপজেলার গিদারী ইউনিয়নের বাগুড়িয়ায় বাঁধের ১০০ ফুট অংশ ধসে গেছে আর ফুলছড়ি উপজেলার কাতলামারী এলাকায় বাঁধ ভেঙে ১৬ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। জেলার বন্যাকবলিত ৪ উপজেলা সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা ও গাইবান্ধা সদরের ২১৩ গ্রাম প্লাবিত হয়ে ২ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বন্যার্তরা বিভিন্ন বাঁধ, আশ্রয় কেন্দ্র, স্কুল ও মসজিদ-মাদ্রাসায় আশ্রয় নিয়েছে। লালমনিরহাট : লালমনিরহাটের দোয়ানী পয়েন্টে গতকাল তিস্তার পানি কমে বিপদসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও কাউনিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এদিকে ধরলার পানি কুলাঘাট পয়েন্টে ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তার পানির তোড়ে জেলার আদিতমারী উপজেলার নদীরক্ষা কুটিরপাড় বাঁধের ২০০ মিটার ধসে গিয়ে হাজারো পরিবার প্লাবিত হয়েছে। গত সাত দিন থেকে চরাঞ্চলের মানুষ পানিবন্দী থাকলেও অধিকাংশ চরেই পৌঁছেনি ত্রাণ কিংবা সাহায্য-সহযোগিতা, দুর্ভোগে পড়েছে বানভাসি মানুষ। মৌলভীবাজার : মৌলভীবাজারের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। কুশিয়ারা, মনু, ধলাই নদ-নদীর পানি বাড়ার ফলে নতুন করে গ্রামাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ইতিমধ্যে জেলার ৩ উপজেলার ৮ ইউনিয়ন ও ১ পৌরসভার অর্ধশতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ। নেত্রকোনা : নেত্রকোনার প্রধান ৪ নদ-নদীর দুটির পানি কমলেও বাড়ছে কংস ও উদ্বাখালী নদীর পানি। ফলে অপরিবর্তিত রয়েছে জেলার বন্যা পরিস্থিতি। মাদারগঞ্জ (জামালপুর) : জামালপুরের মাদারগঞ্জ পৌর এলাকাসহ ৭টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে। এতে নিচু এলাকার আউশ, পাট, বীজতলা, মরিচ, সবজি তলিয়ে গেছে। বন্যার পানিতে ডুবে সাদিয়া (৭) নামে এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। নালিতাবাড়ী : শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার মরিচপুরাণ এলাকায় দুটি স্থানে ভোগাই নদীর ৬৫০ ফুট বাঁধ ভেঙে ৭ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। জলাবদ্ধতায় সড়ক ডুবে থাকায় এবং বাড়িঘরে পানি থাকায় দুই দিন ধরে ৭ গ্রামের মানুষ দারুণ কষ্টের শিকার হচ্ছে। নীলফামারী : নীলফামারীতে তিস্তার ঢলের পানি বিপদসীমা বরাবর বইছে। গতকাল সকালে তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে নদীর পানি বিপদসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিপদসীমা বরাবর প্রবাহিত হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া : ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। বান্দরবান : গত সাত দিন ধরে বান্দরবানের সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সংকট দেখা দিয়েছে বান্দরবানে। তবে জেলার বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। রবিবার বিকাল থেকে আবহাওয়া কিছু ভালো থাকায় নদীর পানি নামতে শুরু করেছে। হবিগঞ্জ : হবিগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নবীগঞ্জ উপজেলার ৩টি ইউনিয়ন আক্রান্ত হয়েছে। বন্যার কারণে ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর