বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

উচ্চ আদালতের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন

প্রবেশপথগুলো অরক্ষিত, বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীর ওপর হামলা, দ্রুত সংকট সমাধানের দাবি আইনজীবীদের

আরাফাত মুন্না

উচ্চ আদালতের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন

কুমিল্লায় বিচারকের খাসকামরায় আসামিকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনার পর উচ্চ আদালতের নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এরই মধ্যে গতকাল সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় বিচার প্রার্থী ও আইনজীবীর ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে। সুপ্রিম কোর্টে কর্মরত আইনজীবীরা মনে করেন, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের নিরাপত্তা পর্যাপ্ত নয়। তারা বলেন, ২০১৫ সালে হাই কোর্টের দুটি এজলাস থেকে বোমা উদ্ধার করা হয়েছিল। তাই বড় ধরনের কোনো ঘটনা ঘটার আগেই উচ্চ আদালতে যথাযথ নিরাপত্তা জোরদারের দাবি আইনজীবীদের।

এদিকে গতকাল সরেজমিন সুপ্রিম কোর্ট এলাকা ঘুরে বেশ কিছু নিরাপত্তা ত্রুটি পাওয়া গেছে। মূল ভবনের নিচতলার প্রবেশপথে একটি আর্চওয়ে ও একটি ব্যাগেজ স্ক্যানার মেশিন লাগানো থাকলেও এসবের যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। দিনের বিভিন্ন সময়ে এ গেটের সামনে অবস্থান করে দেখা গেছে কেউ প্রবেশের সময় আর্চওয়ে শব্দ করলেও প্রবেশকারীকে কোনো তল্লাশি করা হচ্ছে না। আর স্ক্যানার মেশিনের অপারেটরকেও চেয়ারে পাওয়া যায়নি বেশ কিছু সময়। ঠিক তার ওপরের তলার প্রবেশপথেরও একই অবস্থা। একটি মাত্র আর্চওয়ে থাকলেও যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। এদিকে বেলা ২টা ১০ মিনিট থেকে ১৫ মিনিট ধরে সুপ্রিম কোর্টের অ্যানেক্স ভবনের মূল প্রবেশপথে অবস্থান করে আর্চওয়ের একই অবস্থা দেখা গেছে। তবে ওই সময়ে এই পথে লাগানো ব্যাগেজ স্ক্যানার মেশিন সার্ভিসিংয়ের কাজ চললেও অন্তত তিনজনকে তল্লাশি ছাড়াই ব্যাগ নিয়ে ঢুকতে দেখা গেছে।

সরেজমিন আরও দেখা গেছে, মূল প্রবেশপথগুলো একপ্রকার অরক্ষিতই রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েক সদস্যকে গেটে অবস্থান করতে দেখা গেলেও তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়নি। জনসাধারণের প্রবেশের জন্য মূলত সুপ্রিম কোর্টের চারটি গেট ব্যবহার হয়ে থাকে। এর মধ্যে দক্ষিণ পাশের (মাজার) গেট ও তিন নেতার মাজারের পাশের সরু সড়ক দিয়ে গাড়ি ঢুকতে পারে। এ ছাড়া বার কাউন্সিল কর্নার গেট ও সড়ক ভবনের গেট দিয়ে সাধারণ মানুষ পায়ে হেঁটে ঢুকতে পারে। আর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান গেট দিয়ে প্রধান বিচারপতিসহ অন্যান্য বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টে আগত ভিআইপি অতিথিরা ঢুকতে পারেন। এসব গেট দিয়ে গাড়ি প্রবেশের সময় কোনো প্রকার তল্লাশি করতে দেখা যায়নি। এদিকে সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় অবস্থিত অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের সামনে কোনো প্রকার নিরাপত্তা নেই বললেই চলে। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনের প্রবেশেও কাউকে কোনো প্রকার নিরাপত্তা তল্লাশির মুখোমুখি হতে হয় না।

নিরাপত্তা বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় দায়িত্বরত ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (এডিসি) নাদিয়া ফারজানা বলেন, উচ্চ আদালতের নিরাপত্তায় পুলিশের দেড় শতাধিক সদস্য সার্বক্ষণিক নিয়োজিত রয়েছে। তিনি বলেন, গত এপ্রিলে সুপ্রিম কোর্টের নিরাপত্তা বিভাগের দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ে একটি প্রতিবেদন দিয়েছিলাম। সেখানে নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়াদি উল্লেখ করে পর্যাপ্ত আর্চওয়ে স্থাপন, মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে তল্লাশি ব্যবস্থা জোরদার করাসহ নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে কীভাবে আরও কার্যকর করা যায় তা বলা হয়েছে। এ নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন বর্তমানে তাদের কার্যক্রম অব্যহত রেখেছে। আশা করি শিগগিরই নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা সম্ভব হবে। তিনি জানান, সুপ্রিম কোর্টের নিরাপত্তার জন্য হাই কোর্ট সংলগ্ন মাজার অন্যতম একটি সমস্যা। সেখানে যখন তখন পাগল-ফকিরসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ চলাচল করে থাকে। মাজারের পেছনের টয়লেটও তারা ব্যবহার করে। ফলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের প্রায়ই নানা সমস্যায় পড়তে হয়।

সন্তুষ্ট নন আইনজীবীরা : উচ্চ আদালত এলাকার নিরাপত্তায় আইনজীবীরা সন্তুষ্ট নন। জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সুপ্রিম কোর্ট এলাকার নিরাপত্তা পর্যাপ্ত নয়। এখানকার নিরাপত্তা আরও বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, হয়তো পর্যাপ্ত সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এখানে নিয়োগ করা সম্ভব নাও হতে পারে। তার পরও যারা আছে তারাই ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করুন। যেসব যন্ত্রপাতি (আর্চওয়ে ও ব্যাগেজ স্ক্যানার মেশিন) সেগুলোর সঠিক ব্যবহার করুন। কুমিল্লার ঘটনাটিকে দুঃখজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, এমন ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না। সারা দেশের আদালতগুলোর নিরাপত্তায়ও জোর দিতে হবে। জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আমরা অনেক সময়ই দেখি সুপ্রিম কোর্টের প্রবেশপথগুলোতে লাগানো আর্চওয়েগুলোর সঠিক ব্যবহার হয় না। মানুষ ঢোকার সময় আর্চওয়ে শব্দ করলেও তার সঙ্গে কী আছে সেটা দেখার জন্য কেউ থাকে না। তিনি বলেন, হাই কোর্টে সাধারণত আগাম জামিনের বিষয় ছাড়া বিচার প্রার্থীরা সরাসরি আসেন না। তাই জামিন কোর্টের নিরাপত্তায় বেশি জোর দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, ২০১৫ সালে হাই কোর্টের দুটি বেঞ্চ থেকে বোমা উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছিল। আইন বইয়ের ভিতরে করেই ওই বোমা নেওয়া হয়েছিল এজলাসে। তাই বড় কোনো ঘটনা ঘটার আগে উচ্চ আদালতের সার্বিক নিরাপত্তা নিয়ে আরও গভীরভাবে ভাবতে হবে।

বিচার প্রার্থী ও আইনজীবীর ওপর হামলা : হত্যা মামলায় হাই কোর্টে আগাম জামিন পাওয়ায় ক্ষুব্ধ বাদীপক্ষের মারধরের শিকার হয়েছেন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার বাজিতপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম হাওলাদার। এ সময় তার আইনজীবী আবদুল আউয়ালকেও মারধর করা হয়েছে।

গতকাল সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনেই ঘটনাটি ঘটে।

মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার বাজিতপুর ইউনিয়নের একটি হত্যা মামলার প্রধান আসামি পলাতক সিরাজুল ইসলাম আগাম জামিন নিতে হাই কোর্টে আসেন। তিনি আগাম জামিনও পান। এরপর বেলা ১টা ১০ মিনিটে সিরাজুল ইসলামের ওপর হামলা চালায় বাদীপক্ষের জুয়েল বাচ্চুসহ অন্যরা। সিরাজুলকে বাঁচাতে তার আইনজীবী এগিয়ে এলে তাকেও মারধর করা হয়। পরে হামলাকারীদের আটকের পর পুলিশে খবর দেয় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি। এ ঘটনায় হামলাকারী জুয়েল নামের এক যুবককে পুলিশে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে হামলার শিকার সিরাজুল ইসলাম বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় এ বিষয়ে একটি মামলাও করেছেন।

সর্বশেষ খবর