বুধবার, ১৭ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

বন্যায় প্লাবিত ২৩ জেলায় বিপদ বাড়ছে

পাঁচ শিশুসহ সাত জনের মৃত্যু

নিজস্ব প্রতিবেদক

বন্যায় প্লাবিত ২৩ জেলায় বিপদ বাড়ছে

জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার বেলগাছা ইউনিয়নের ছোট দেলিরপাড় গ্রাম ডুবে গেছে বন্যার পানিতে -বাংলাদেশ প্রতিদিন

টানা বর্ষণ ও উজানের অভিন্ন নদীর পানির তোড়ে দেশের ২৩টি জেলার বিভিন্ন অঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।  আরও নতুন এলাকায় বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পানিবন্দী হয়ে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছেন লাখ লাখ মানুষ। কুড়িগ্রামের উলিপুরে চার শিশুসহ পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। জামালপুরে বন্যার পানিতে ডুবে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। গাইবান্ধায় মারা গেছে এক যুবক। বাড়িঘর পানিতে ডুবে যাওয়ায় বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ তাদের পরিবার-পরিজন আর গবাদি পশু নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন নিকটবর্তী উঁচু বাঁধে। অনেকেই  ঠাঁই নিয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্র ও স্কুল-কলেজ বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবনে। শত শত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ হয়ে গেছে। কোনো কোনো জেলায় তীব্র হয়ে উঠছে নদীভাঙন। সর্বকালের রেকর্ড ভেঙে যমুনা নদীর পানি গতকাল সকালে জামালপুরের বাহাদুরাবাদ ঘাট এলাকায় বিপদসীমার ১৩৭ সেন্টিমিটারের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার তথ্য রেকর্ড করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ১৯৮৮ সালের বন্যায় যমুনার সর্বোচ্চ রেকর্ড ছিল ১২১ সেন্টিমিটার আর ২০১৭ সালে এটা ছিল ১৩৪  সেন্টিমিটার। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা সতর্কীকরণ ও পূর্বাভাস কেন্দ্র জানিয়েছে, গতকাল সকাল থেকে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র-যমুনা এবং গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে। বাংলাদেশ ও ভারতের আবহাওয়া বিভাগ তাদের পূর্বাভাসে বলেছে, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং এর সংলগ্ন ভারতের আসাম ও মেঘালয় প্রদেশগুলোর বিস্তীর্ণ এলাকায় আগামী ২৪ ঘণ্টায় মাঝারি থেকে ভারি এবং কোথাও কোথাও অতি ভারি বৃষ্টিপাত হতে পারে। ফলে কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটতে পারে। অপরদিকে নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলায় বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল বা সার্বিক অপরিবর্তিত থাকতে পারে। বন্যা আক্রান্ত জেলাগুলোতে ডায়েরিয়া, শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ, চোখের প্রদাহ ও চর্মরোগসহ নানা রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরে হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম জানিয়েছে, স্বাস্থ্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় ১৬ জেলায় ১,৫৪৩টি মেডিকেল টিম কাজ করছে।

দুর্যোগ মন্ত্রীর আশ্বাস : দেশের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে, তবে এতে শঙ্কার কিছু নেই বলে আশ্বস্ত করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান। গতকাল সকালে রাজধানীতে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) সঙ্গে বৈঠক  শেষে তিনি একথা জানান। তিনি বলেন, ‘টানা বর্ষণ অব্যাহত থাকায় ১৫টি নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে। বৃষ্টি আরও বাড়বে, ব্রহ্মপুত্রের ভয়ানক অবস্থা। তাই বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। তবে এ নিয়ে আমরা চিন্তিত নই। পর্যাপ্ত খাবার মজুদ আছে। সারা দেশ থেকে প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :

কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার বন্যাকবলিত এলাকায় স্বজনদের দেখতে গিয়ে নৌকা ডুবে চার শিশুসহ পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। গুরুতর আহত হয়েছেন আরও তিনজন। তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। গতকাল দুপুরে উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের নতুন অনন্তপুর গ্রামে এ দুর্ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার পর থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে স্থানীয়রা ও ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল নিহতদের মরদেহ উদ্ধার করে।

জামালপুর : জামালপুরের বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে যমুনার পানি সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে বিপদসীমার ১৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার সাত উপজেলার তিন লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী রয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে ২৭৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বন্যার পানিতে ডুবে ইসলামপুর উপজেলার গোয়ালেরচর ইউনিয়নের মালমারা গ্রামের ফারুক মিয়ার ছেলে আব্দুল্লাহ (৪) মারা যায়। যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, ঝিনাই, জিঞ্জিরামসহ শাখা নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জামালপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।

সিরাজগঞ্জ : যমুনা নদীর পানি সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমার ৫২ সে.মি. মিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। ইতিমধ্যে ৩০ হাজার পরিবারের প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে সদর উপজেলার কাওয়াকোলা ও মেছড়া ইউনিয়নের প্রায় ৩০টি গ্রাম পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে পড়েছে পানিবন্দীরা।

গাইবান্ধা : গাইবান্ধায় সার্বিক বন্যা পরিস্থিতিরি আরও অবনতি ঘটেছে। সোমবার রাত থেকে জেলা শহরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় পানি ঢুকতে শুরু করে। ফলে পৌর শহরের ৭টি পাড়া ইতিমধ্যে পানিতে তলিয়ে গেছে। গাইবান্ধা-সুন্দরগঞ্জ সড়ক এবং বালাসি-গাইবান্ধা সড়কের দুটি স্থানে পানি উঠে পড়ায় যান চলাচল হুমকির মুখে পড়েছে। এদিকে সোমবার বিকালে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার গেন্দুরাম গ্রামে বন্যার পানিতে ডুবে আনারুল ইসলাম (৩২) নামের এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। আনারুল ওই গ্রামের দুলা মিয়ার ছেলে।

বগুড়া : বগুড়ায় যমুনা ও বাঙালি নদীর পানি বেড়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। গত চার দিন ধরে পানি বৃদ্ধির ফলে শতাধিক গ্রামে পানি ঢুকেছে। পানিবন্দী হয়ে আছে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ। ইতিমধ্যে জেলার প্রায় ৯০০ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। আরও ৩ দিন পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে বাউবো কর্মকর্তারা জানান। গতকাল দুপুরে বগুড়ার মথুরাপাড়া পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বন্যা দুর্গত এলাকায় ২ হাজার ৪৫৭টি টিউবওয়েল বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হওয়ায় খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

নীলফামারী : নীলফামারীতে তিস্তার বন্যায় ডিমলা উপজেলায় ১৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। গতকাল বিকাল পর্যন্ত জেলার ডালিয়ায় তিস্তা ব্যারাজ পয়েণ্টে নদীর পানি বিপদসীমা বরাবর প্রবাহিত হওয়ায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি তিস্তাপাড়ের বন্যা পরিস্থিতির। ফলে এসব বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে।

দিনাজপুর : দিনাজপুরের নদী এলাকার নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হওয়ায় পানিবন্ধী হয়েছেন শত শত মানুষ। কেউ শহর রক্ষা বাঁধে আশ্রয় নিচ্ছেন বা অন্যত্র নিরাপদ স্থানে সরে যাচ্ছেন। দিনাজপুরে পুনর্ভবা, আত্রাই ও ছোট যমুনা এই তিনটি নদীর পানি বিপদসীমার কাছাকাছি অবস্থান করলেও গতকাল দুপুর থেকে সবকটি নদীর পানি কমতে শুরু করেছে বলে জানায় পাউবো কর্মকর্তারা।

মৌলভীবাজার : মৌলভীবাজারে কুশিয়ারা, মনু ও ধলাই নদীর পানি বাড়ার ফলে নতুন করে গ্রামাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। জেলার ৬টি উপজেলার ২৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভার শতাধিক গ্রামে পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন লক্ষাধিক মানুষ। মনুর পানি চাঁদনীঘাট ব্রিজ এলাকায় বিপদসীমার ৯৯ সে.মি ওপর দিয়ে ও মনু রেলওয়ে ব্রিজ এলাকায় বিপদসীমার ৫ সে.মি নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ধলাই বিপদসীমার ১৯ সে.মি নিচে ও কুশিয়ারা বিপদসীমার  ৫৬ সে.মি ওপরে প্রবাহিত হচ্ছে।

শেরপুর : শেরপুরের পাঁচটি উপজেলার বন্যার পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। লাখো মানুষ পানিবন্দী রয়েছে ওইসব উপজেলায়। পানিবন্দী মানুষের দাবি, সরকারিভাবে ত্রাণ পাচ্ছেন না তারা। বন্যার কারণে জেলায় বিভিন্ন এলাকায় অর্ধশত স্কুলে পাঠদান বন্ধ রয়েছে।

নেত্রকোনা : নেত্রকোনায় কংশ নদীর পানি ২০ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ১৫০ সেন্টিমিটারের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কমেছে সোমেশ্বরী ও ধনু নদীর পানি। অপরিবর্তিত রয়েছে কলমাকান্দার উব্দাখালি নদীর পানি। নদী তীরবর্তী গ্রামগুলো এখনো পানিতে নিমজ্জিত। বীজতলা নষ্টসহ পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। বাড়ি ঘর থেকে বের হতে পারছে না মানুষ। গ্রামীণ সড়কগুলোও ডুবে রয়েছে।

সিলেট : সিলেটে চলতি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ। বন্যার জন্য বন্ধ হয়ে গেছে ১৬০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান। তবে গতকাল থেকে সিলেটের সুরমা ও কুশিয়ারাসহ সবকটি নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। টানা বৃষ্টিপাত না হলে আজকের মধ্যে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এদিকে, বন্যা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।

হবিগঞ্জ : হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর পানি বেড়ে বাঁধ ভেঙে ৩টি ইউনিয়নের প্রায় ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে অমানবিক জীবনযাপন করছেন হাজারও পরিবার। বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন কয়েকশ পরিবার।

সর্বশেষ খবর