গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, বগুড়া, জামালপুরসহ উত্তরের বিভিন্ন জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। প্রতিদিনই প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। পদ্মা ও যমুনার পানি বেড়ে যাওয়ায় দুটি স্থানে রেল যোগাযোগ এবং পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ও শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী নৌরুটে অধিকাংশ ফেরি চলা বন্ধ হয়ে গেছে। লালমনিরহাট, শেরপুর ও গাইবান্ধায় তিন শিশুসহ মারা গেছে চারজন। লালমনিরহাটের বাদিয়াখালী ও ত্রিমোহিনী এলাকায় রেললাইন ডুবে যাওয়ায় বুধবার থেকে দ্বিতীয় দিনের মতো বন্ধ রয়েছে ট্রেন চলা। জামালপুরেও রেললাইন তলিয়ে গেছে। যমুনার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বগুড়ার ১০২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। হাজার হাজার পরিবার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। যমুনার পানির প্রবল স্রোতে সিরাজগঞ্জের কাজীপুরে উপজেলা পরিষদের নির্মিত রিংবাঁধের অন্তত ৬০ মিটার অংশ ধসে নতুন নতুন এলাকা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ডুবে গেছে। সুনামগঞ্জে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও এখনো নিম্নাঞ্চলের বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে। ভেসে গেছে হাজার হাজার পুকুরের মাছ। ক্ষতির মুখে পড়েছেন মাছ চাষিরা। তলিয়ে আছে সবজিসহ ফসলের জমি। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
লালমনিরহাট : লালমনিরহাটের ধরলা নদীর বন্যার পানিতে ডুবে গতকাল ইশিমণি (২) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বিকালে সদর উপজেলার কুলাঘাট ইউনিয়নের ওয়াপদা বাজারের পাশে ধরলা নদী থেকে শিশুটির লাশ উদ্ধার করা হয়। শিশু ইশিমণি ওয়াপদা বাজার এলাকার মজনু মিয়ার ছেলে। কয়েকদিনের টানা বৃষ্টিতে ধরলার পানি বেড়ে বাড়িতে ওঠায় শিশু ইশিমণিকে উঁচু স্থানে রেখে কাজ করছিল পরিবারের লোকজন। তবে সবার অজান্তে বন্যার পানিতে পড়ে শিশুটির মৃত্যু হয়। এদিকে লালমনিরহাটের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছে। নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। তবে নদীর পানি কমতে শুরু করায় জেলায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। টানা আট দিনের বন্যার উন্নতির সঙ্গে তিস্তায় বেড়েছে ভাঙন। লালমনিরহাটে তিস্তার তীরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ স্প্যারে ধসে গেছে সিসি ব্লক। সন্ধ্যা পর্যন্ত জিও ব্যাগ ফেলে বাঁধ রক্ষা করতে দেখা গেছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীদের।
শেরপুর : পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদে পানি বৃদ্ধি ও পাহাড়ি ঢলের ফলে শেরপুরে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। সদর উপজেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পুরাতন ভাঙা অংশ দিয়ে পানি ঢুকে চরাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পানি শেরপুর ফেরিঘাট পয়েন্টে ১ মিটার বেড়ে বিপদসীমা ছুঁইছুঁই করছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। শেরপুর-জামালপুর সড়কের নন্দীর বাজার পোড়ার দোকান কজওয়ের (ডাইভারশন) ডুবে কজওয়ের ওপর দিয়ে প্রায় ২ ফুট উচ্চতায় বন্যার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলায় বন্যার পানিতে ডুবে আরও দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এতে গত পাঁচ দিনে বন্যার পানিতে ডুবে ছয়জনের মৃত্যু হলো।জামালপুর : যমুনার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জামালপুরের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গতকাল যমুনার পানি বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে বিপদসীমার ১৬৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। মাদারগঞ্জে ভেঙে গেছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। রেললাইনের বিভিন্ন স্থানে পানি ওঠায় জামালপুর-সরিষাবাড়ী-বঙ্গবন্ধু সেতুলাইনে ট্রেন চলা বন্ধ রয়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় নতুন করে জামালপুরের সাতটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। সব মিলিয়ে জামালপুরের সাত উপজেলার ৬৮টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫৯টি বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ৫ লক্ষাধিক মানুষ। এদিকে জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলায় বন্যা ও নদী ভাঙনকবলিত বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছেন সাবেক বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম এমপি। দুপুরে দুরমুট ইউনিয়নের চরহাতিজা ও মাহমুদপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেন তিনি।
বগুড়া : বগুড়ার তিনটি উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চলমান বন্যায় ধীরে ধীরে সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। সরকারিভাবে ত্রাণ পৌঁছানো হলেও গবাদি পশুর খাবার সংকটের সঙ্গে সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। বন্যার পানি লোকালয়ে প্রবেশ করায় রাস্তাঘাট, খেতের ফসল নষ্ট হচ্ছে। দুপুর ১২টায় সারিয়াকান্দি উপজেলার মথুরাপাড়া পয়েন্টে যমুনার পানি বিপদসীমার ১২৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সারিয়াকান্দির বাঙালি নদীর পানি বাড়তে শুরু করেছে।
রংপুর : বন্যায় নিমজ্জিত রংপুর বিভাগের ছয়টি জেলার ৫৪৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে নদীতে বিলীন হয়েছে সাতটি বিদ্যালয় ভবন। এ ছাড়া বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও ১৬৭টি বিদ্যালয়। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত জেলার একটি হলো গাইবান্ধা। এ জেলায় চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন নদীতে বিলীন হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলার একটি ও ফুলছড়ি উপজেলার তিনটি বিদ্যালয় রয়েছে। কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী ও রাজীবপুরে দুটি বিদ্যালয় নদীতে তলিয়ে গেছে। বিলীন হওয়া অন্য স্কুলটি লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায়। বন্যায় গাইবান্ধার ৯৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া পানি প্রবেশ করায় পাঠদান বন্ধ রয়েছে ১৯০টি বিদ্যালয়ে।
টাঙ্গাইল : টাঙ্গাইলে প্রায় সব কটি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গতকাল সকালে যমুনার পানি বিপদসীমার ১৫, ধলেশ্বরীর ১২ ও ঝিনাই নদীর পানি ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। পানি বৃদ্ধির কারণে জেলার পাঁচ উপজেলায় নদীতীরবর্তী ২২টি ইউনিয়নের প্রায় ১০৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
নওগাঁ : নওগাঁর মান্দার আত্রাই নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে কসবা ও বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের ২০টি গ্রাম এবং নতুন করে আত্রাই উপজেলার হাটকালুপাড়া ইউনিয়নের ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। আত্রাই নদীর বাঁধ ভেঙে কসবা, বিষ্ণুপুর ও হাটকালুপাড়া ইউনিয়নের ৩০টি গ্রামের অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। সঙ্গে জোতবাজার, বানডুবি, বাগাতিপাড়া, গোয়ালমান্দা, কালিকাপুর, দ্বারিয়াপুর বেড়িবাঁধ, খুদিয়াডাঙ্গা পূর্বপাড়সহ অন্তত ৩০টি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
গাইবান্ধা : সপ্তাহব্যাপী চলমান বন্যা গাইবান্ধায় ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদের পানি প্রতিদিনই বাড়ছে। গতকালও ব্রহ্মপুত্রের পানি ৭ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ১৫০ সেন্টিমিটার ও ঘাঘটের পানি ৫ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৯৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়।
মানিকগঞ্জ : পদ্মার প্রবল স্রোতে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ফেরি চলা মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। স্রোতের কারণে মাঝ নদীতে গিয়ে কয়েকটি ফেরি ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে। প্রবল স্রোত ও ফেরি সংকটের কারণে ট্রিপসংখ্যা কমে গেছে।
মাদারগঞ্জ (জামালপুর) : জামালপুরের মাদারগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটেছে। জেলা সদরের সঙ্গে সাতটি ইউনিয়ন ও পৌর এলাকার আংশিক যোগাযোগ উপজেলা সদরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। গতকাল সকাল থেকে জামালপুর-মাদারগঞ্জ সড়ক বন্যার পানিতে ডুবে থাকায় যানবাহন চলা বন্ধ রয়েছে।
সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জের ৩৬টি ইউনিয়নের ২৭৭টি গ্রাম ও দুটি পৌরসভা প্লাবিত হয়ে আড়াই লক্ষাধিক মানুষ অমানবিক জীবনযাপন করছে। রান্নাঘরসহ চুলা তলিয়ে যাওয়ায় রান্না করতে না পেরে অনেকে একবেলা খেয়ে দিন পার করছে। টাকা না থাকায় শুকনা-তরল খাবার কিনতে না পারায় ছোট ছোট শিশুদের খাদ্যকষ্টে ভুগতে হচ্ছে। টিউবওয়েল তলিয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। সারাক্ষণ পানির মধ্যে থাকায় হাত-পায়ে ঘা দেখা দিয়েছে।
মাদারীপুর : পদ্মার পানি বৃদ্ধি পেয়ে শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ী নৌরুটে তীব্র ঘূর্ণিস্রোতে ১২টি ফেরি পারাপার বন্ধ হয়ে গেছে। কোনোমতে চারটি ফেরি চলছে। ফেরি বন্ধ থাকায় উভয় ঘাটে সহস্রাধিক যানবাহন আটকে পড়ে পড়ায় যাত্রীরা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।