শনিবার, ২০ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

পানির সঙ্গে বাড়ছে দুর্ভোগ

তিন শিশুসহ পাঁচজনের মৃত্যু, নেই পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী, নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত

নিজস্ব প্রতিবেদক

পানির সঙ্গে বাড়ছে দুর্ভোগ

বন্যায় তলিয়ে যাওয়া জামালপুরের ইসলামপুরের একটি গ্রাম -বাংলাদেশ প্রতিদিন

পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘটসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় পানিবন্দী মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। নদীভাঙন ও বন্যার বিস্তারের কারণে হাজার হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শত শত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

বন্যায় বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার হেক্টর জমির ধান-পাট ও সবজি খেত নষ্ট হয়ে গেছে। সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রাজধানীসহ সর্বত্র সবজির দাম বেড়ে গেছে। ভেসে গেছে শত শত পুকুরের মাছ। সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বন্যা প্লাবিত এলাকায় খাবার পানি, শুকনো খাবারসহ ত্রাণসামগ্রীর অভাব দেখা দিয়েছে। বন্যার পানি বিপদসীমার ৯৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় যমুনা ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার সুরেশ^র পয়েন্টে পদ্মার পনি গত এক সপ্তাহে ১০০ সেন্টিমিটার বেড়েছে। এ কারণে নড়িয়া-জাজিরার পদ্মার ডান তীর রক্ষা কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। স্রোতোর কারণে বালুবাহী নৌযান বাল্কহেড চলতে পারছে না। গত এক সপ্তাহ থেকে অব্যাহতভাবে গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘটের পানি বাড়তে থাকলেও গত ২৪ ঘণ্টায় তা কিছুটা কমতে শুরু করেছে। জেলার ছয় উপজেলার ৩৭টি ইউনিয়নের ২৫৩টি গ্রাম পানিতে ডুবে আছে।

বন্যা ঝুঁকির মুখে ৪০ লাখ মানুষ : গত কয়েক দিন ব্যাপক বৃষ্টির কারণে বাংলাদেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তাতে দেশের ৪০ লাখের বেশি মানুষ খাদ্য, নিরাপত্তাহীনতা ও রোগ-ব্যাধির ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। বন্যা ও ভূমিধসের ফলে রাস্তাঘাট এবং গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় লাখো মানুষ আটকা পড়েছে ও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে। গতকাল ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেডক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজ (আইএফআরসি) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে। তাতে বলা হয়, এরই মধ্যে ৬৬ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খাদ্য ও পরিচ্ছন্ন পানির অভাব এবং পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বৃদ্ধির খবরও পাওয়া গেছে। বিজ্ঞপ্তিতে আইএফআরসির বাংলাদেশ প্রধান আজমত উল্লাহ বলেন, এসব মানুষ মৌসুমি বৃষ্টি, বন্যার প্রকোপ ও ভূমিধসে নাকাল হচ্ছে। এমনকি বৃষ্টি কমলেও উজান থেকে নদীগুলোর উপচেপড়া প্রবাহে সামনের দিনগুলোতে বন্যার অবনতি ঘটাবে।

এদিকে গতকাল দুপুরে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় বন্যার পানিতে ডুবে মুন্নি আক্তার (৯) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। শেরপুরের সঙ্গে উত্তরাঞ্চল হয়ে রাজধানী ঢাকার সড়ক যোগাযোগ গতকাল বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সকাল ও দুপুরে বন্যার পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তাদের একজন পৌর এলাকাল উত্তর গৌরিপুরের সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া নায়েব আলীর পুত্র মেহেদি হাসান (১৩)। অন্যজন কামারের চর এলাকার মোফাজ্জলের ছেলে শামিম হোসেন (৬)। জামালপুরে মারা গেছে দুজন। সারা দেশের আরও বন্যার খবর দিয়েছেন আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা। সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে যমুনার পানি বিপদসীমার ৯৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় নদীতীর এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে ২ হাজার পরিবারের ঘরবাড়ি ও ছয়টি বিদ্যালয় সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। স্রোত ও পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় প্রায় ৪০ হাজার ঘর ও ১৬৬ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় ৩০০ কিলোমিটার রাস্তা ও ১৫টি ব্রিজের ক্ষতি হয়েছে। ৮ হাজার হেক্টর জমির ধান-পাট ও সবজি খেত নষ্ট হয়ে গেছে। প্রবল স্রোতের কারণে রাতে শহররক্ষা বাঁধ হার্ড পয়েন্টে সিসি ব্লক সরে যাওয়ায় ভাঙন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল শহরবাসীর মধ্যে।

গাইবান্ধা : গত এক সপ্তাহ থেকে গাইবান্ধায় ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘটের পানি বাড়তে থাকলেও গত ২৪ ঘণ্টায় কিছুটা কমতে শুরু করেছে। কিন্তু এতে জেলা সদরসহ পাঁচ উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির ভয়াবহতা কমেনি। জেলার ছয় উপজেলার ৩৭টি ইউনিয়নের ২৫৩টি গ্রাম পানিতে ডুবে আছে। গতকাল দুপুরে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় বন্যার পানিতে ডুবে মুন্নি আক্তার নামে ৯ বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এদিকে বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও ত্রাণ বিতরণে গতকাল গাইবান্ধা আসেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান ও পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম। জামালপুর : যমুনার পানি সামান্য কমলেও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জামালপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। জামালপুরের ৬৮টি ইউনিয়নের মধ্যে ৬১টিতেই এখন বন্যা। এখনো পানিবন্দী হয়ে আছে ৫ লাখের বেশি মানুষ। বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে পানিবাহিত রোগ। বন্ধ রয়েছে ৯৮৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান। বিশুদ্ধ পানি, শুকনো খাবার ও গোখাদ্যের চাহিদা তীব্র হয়ে উঠেছে। জামালপুরের সিভিল সার্জন ডা. গৌতম রায় জানান, গতকাল সকালে বকশীগঞ্জ উপজেলার বগারচর ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামে মৃত গিয়াস উদ্দিনের ছেলে আবু বক্কর (৫০) বন্যার পানিতে মাছ ধরতে গিয়ে ডুবে যায়। পরে তার লাশ উদ্ধার করেন স্থানীয়রা। অন্যদিকে ইসলামপুরের গিলাবাড়ী এলাকায় মশিউর রহমান (৩০) নামে এক যুবকের পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে। সে ওই এলাকার ছামিউল ম-লের ছেলে। শেরপুর : শেরপুর-জামালপুর মহাসড়কের পোড়ার দোকান এলাকায় কজওয়ের (ডাইভারশন) ওপর দিয়ে প্রবল বেগে বন্যার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে গতকাল সকাল থেকেই এ সড়কে শেরপুর থেকে রাজধানী ঢাকাসহ উত্তরাঞ্চলের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে। সকাল ও দুপুরে বন্যার পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তাদের একজন পৌর এলাকাল উত্তর গৌরিপুরের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র নায়েব আলীর পুত্র মেহেদি হাসান (১৩)। অন্যজন কামারের চর এলাকার মোফাজ্জলের ছেলে শামিম হোসেন (৬)। নাটোর : নাটোরের সিংড়া উপজেলায় বন্যার পানির স্রোতে বক্তারপুর ব্রিজ ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ব্রিজ ভাঙার কারণে উপজেলা সদরের সঙ্গে অন্তত ৩০টি গ্রামের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। শরীয়তপুর : শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানান, গতকাল বিকালে পদ্মা নদীর সুরেশ^র পয়েন্টে ৪০১ সেন্টিমিটার পানি প্রবাহিত হয়েছে; যা বিপদসীমার ৪৫ সেন্টিমিটার নিচে রয়েছে।  কুড়িগ্রাম : ব্রহ্মপুত্র, দুধকুমার নদ ও ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে বইছে। ভাসছে ৯ উপজেলার ৫৭৮টি গ্রাম। পানিবন্দী প্রায় ২ লাখ মানুষ। বগুড়া : বগুড়ার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনটেও বন্যা পরিস্থিতি আগের মতোই। থাকা-খাওয়ার সমস্যার পাশাপাশি দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগ।

সর্বশেষ খবর