শুক্রবার, ২৬ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

বিএনপি ছাড়ছেন ঢাকার নেতারা

কেউ স্থানীয় কাউন্সিলরের কাছে কেউ পুলিশের কর্মকর্তাদের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠাচ্ছেন

মাহমুদ আজহার

বিএনপি ছাড়ছেন ঢাকার নেতারা

সম্প্রতি ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি সহসভাপতি শামসুল হক ও  সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ মঞ্জুর হোসেনকে শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে দলীয় সব পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, এ দুই নেতা দীর্ঘদিন ধরে দলীয় কোনো কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন না।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মামলাসহ নানামুখী চাপে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ মঞ্জুর হোসেন সম্প্রতি জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েছেন। পার্টির বনানী অফিসে জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে তিনি জাপায় যোগ দেন। সহসভাপতি শামসুল হক স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের কাছে ‘মুচলেকা’ দিয়ে বিএনপির রাজনীতিকে ‘গুডবাই’ জানিয়েছেন। একইভাবে উত্তরা পশ্চিম থানা বিএনপির সভাপতি হাজী দুলালও বিএনপির রাজনীতিকে বিদায় জানিয়েছেন। তবে তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও ৫১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কাছে।

শুধু এই তিন নেতাই নন, ঢাকা মহানগর বিএনপির দক্ষিণ ও উত্তর শাখার বেশ কয়েকজন নেতা বিএনপির রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়েছেন। কেউ কেউ সরাসরি আওয়ামী লীগ বা জাতীয় পার্টির রাজনীতি করছেন। কেউ পুলিশের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে বলছেন, তিনি বিএনপি করেন না। কেউ কেউ মামলা-হামলা থেকে রেহাই পেতে ‘মুচলেকা’ দিয়ে বিএনপির রাজনীতিতে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছেন। বিএনপি থেকে নির্বাচিত  আসছেনই না, কেউ পালিয়ে বিদেশে আছেন। কেউ দেশে থাকলেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে-মিশে এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও সহায়-সম্পত্তি টিকিয়ে রেখেছেন। বাসাবাড়িতে থাকছেন থানা পুলিশ ও আওয়ামী লীগকে ‘ম্যানেজ’ করেই। এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার সাধারণ সম্পাদক কাজী আবুল বাশার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সরকার ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের চাপে কেউ কেউ বিএনপি ছাড়ছেন। হামলা-মামলাসহ নানামুখী নির্যাতন করা হচ্ছে নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। অনেকেই চাপ সহ্য করতে পারেন না। তাই বাধ্য হয়ে দল ছাড়েন। তবে যত বাধাই আসুক, বিএনপিকে আটকানো যাবে না। দিন যতই যাচ্ছে, বিএনপি আরও বেশি শক্তিশালী হচ্ছে। দল ঘুরে দাঁড়াবেই।’

জানা যায়, উত্তরা পশ্চিম থানা বিএনপির সভাপতি হাজী দুলাল বিএনপির রাজনীতিকে গুডবাই জানিয়েছেন। তবে তিনি পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও ৫১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কাছে। ওই কাউন্সিলরকে লেখা পদত্যাগপত্রে তিনি নিজেকে হার্টের রোগী, শারীরিক অসুস্থতা ও নিজের বয়স ৬০ উল্লেখ করেছেন। বিএনপির কর্মসূচি পালনে অক্ষম উল্লেখ করে হাজী দুলাল বলেন, তিনি স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে ও সুস্থ মস্তিষ্কে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শারীরিক ও পারিবারিক কারণ দেখিয়ে ঢাকা মহানগর উত্তরের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ শাহাবউদ্দিন আহমেদ দল ছেড়েছেন। তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাও ছিলেন। ঢাকা-১২ আসনে (তেজগাঁও এলাকা) মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ায় মূলত তিনি দল ছাড়েন। ওই আসনে নির্বাচন করেন যুবদলের সভাপতি সাইফুল আলম নীরব। তবে স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা বলছেন, ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখা ও মামলা থেকে রেহাই পেতেই দল ছেড়েছেন শাহাবুদ্দিন। 

জানা যায়, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সহসভাপতি আবদুল মোতালেব দল ছেড়েছেন আওয়ামী লীগের চাপে। সম্প্রতি তিনি সমঝোতার কমিটিতে এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক নির্বাচিত হয়েছেন। এ জন্য তার ওপর চাপ ছিল বিএনপির রাজনীতি ছাড়তে হবে। পরে তিনি বিএনপি থেকে অব্যাহতি নেন। একই শাখার নেতা কোতোয়ালি থানা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মোল্লা সাইফুলও বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেছেন। স্থানীয় এমপির চাপে তাকে বিএনপি ছাড়তে হয়েছে বলে মহানগর বিএনপির সিনিয়র এক নেতা জানিয়েছেন। ওই নেতা জানান, সাইফুল ও তার ভাই বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক মামলার আসামি। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা তাদের নানাভাবে চাপ দিচ্ছিলেন। দল ছাড়লে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে এমন আশ্বাসে মোল্লা সাইফুল বিএনপিকে বিদায় দেন। দারুস সালাম বিএনপির সভাপতি হাজী আবদুর রহমানও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যোগসাজশ করে রাজনীতি করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। দলে নিষ্ক্রিয়তাসহ নানা কারণে তাকে অবশ্য বিএনপি থেকেও বহিষ্কার করা হয়েছে। ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বাচ্চুও দল থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে তিনি কেন নিয়েছেন তা এখনো পরিষ্কার নয়।  সর্বশেষ ২০১৭ সালের ১৮ এপ্রিল মহানগরকে দুই ভাগ করে নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। দলের যুগ্ম-মহাসচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেলকে সভাপতি ও সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজী আবুল বাসারকে সাধারণ সম্পাদক করে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির ৭০ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়। আর এম এ কাইয়ুমকে সভাপতি ও আহসানউল্লাহ হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে ঘোষণা করা হয় উত্তরের কমিটি। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, কমিটির মেয়াদ দুই বছর। সে হিসাবে দুই শাখার কমিটির মেয়াদ ইতিমধ্যে শেষ হয়ে গেছে। বিএনপি থেকে নির্দেশনা ছিল, এক মাসের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে হবে। কিন্তু দিন মাস বছর গড়িয়ে কমিটিরই মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে, পূর্ণাঙ্গ কমিটি আর হয়নি। শুধু তাই নয়, দুই সিটির যেসব থানা ও ওয়ার্ডের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল সেগুলোও পূর্ণাঙ্গ হয়নি। দীর্ঘ ১০ মাস কারাবরণের পর সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখার সভাপতি হাবিব-উন নবী খান সোহেল। এর আগে তিনি প্রায় এক বছর আত্মগোপনে ছিলেন। ওই শাখার সাধারণ সম্পাদকও কিছুদিন আগে প্রায় তিন মাস কারাবরণ করে জামিনে মুক্তি পান। ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি এম এ কাইয়ুম কমিটি ঘোষণার আগ থেকেই দেশ ছেড়েছেন। এক বিদেশি হত্যা মামলার প্রধান আসামি হয়ে তিনি এখন মালয়েশিয়া অবস্থান করছেন। ওই শাখার সাধারণ সম্পাদক হাসান মামলার অজুহাত দেখিয়ে কমিটি হওয়ার পর থেকেই আত্মগোপনে। কমিটি গঠনে তার বিতর্কিত ভূমিকাও ছিল। কমিটি নিয়ে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগও ছিল তার বিরুদ্ধে। উত্তর শাখা সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হওয়ার পেছনে তাকেই দায়ী করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে ঢাকা মহানগর বিএনপি অনেকটা অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে।

সর্বশেষ খবর