রবিবার, ২৮ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

আসছেই একে ২২ রাইফেল

মির্জা মেহেদী তমাল

আসছেই একে ২২ রাইফেল

জঙ্গি থেকে পেশাদার কিলার-সবারই হাতে এখন রোমানিয়ায়  তৈরি অ্যাসল্ট কালাশনিকভ রাইফেল। তবে এই রাইফেল এ কে-৪৭ বা এ কে ৫৬-র মতো কুলীন গোত্রের নয়। এর নাম এ কে-২২। গত মাসে রাজধানীর শ্যামপুর থেকে এ কে ২২ অটোমেটিক রাইফেল উদ্ধার করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট- সিটিটিসি। গত বুধবার খিলগাঁও থেকে উদ্ধার হয় আরও একটি এ কে ২২ অটোমেটিক রাইফেল। এ সময় গ্রেফতার হয় তিনজন পেশাদার কিলার। গত ছয় মাসে রাজধানীতে আরও তিনটি একই ধরনের ভারী অস্ত্র হাতবদল হয় বলেও খবর রয়েছে গোয়েন্দাদের কাছে।  জানা গেছে, ২০১৬ সালে হলি আর্টিজান বেকারিতে যে এ কে ২২ রাইফেল ব্যবহার করেছিল জঙ্গিরা, ঢাকা থেকে উদ্ধার হওয়া এসব অস্ত্র একই। এ ছাড়া ওই বছরের ২৬ জুলাই কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানাতেও অভিযানের পর পুলিশ কর্মকর্তারা জানতে পারেন, একটি এ কে ২২ অটোমেটিক রাইফেল নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল এক জঙ্গি।

সংশ্লিষ্টরা বলছে, রাজধানী ঢাকায় অত্যাধুনিক ও ভারী অস্ত্রের জোগান বাড়ছে। গত কয়েক দিনে একাধিক অভিযানে এ কে  টোয়েন্টি-টু অটোমেটিক রাইফেলসহ বিদেশি অত্যাধুনিক অস্ত্র উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এসব অস্ত্রের গন্তব্য নিয়ে চিন্তিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। পেশাদার অপরাধী নাকি জঙ্গিদের কাছে যাচ্ছে এসব অস্ত্র? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গোয়েন্দারা এখন মাঠে।

সর্বশেষ খিলগাঁও এলাকা থেকে এ কে ২২ রাইফেল উদ্ধার হয়। পুলিশ জানায়, রাজধানীর খিলগাঁও সিপাহীবাগ এলাকার একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে অত্যাধুনিক এ কে-২২ রাইফেলসহ দুই সহোদরসহ সন্ত্রাসী চক্রের তিনজনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তারা হলো- খান মো. ফয়সাল, রেজাউল আবেদীন ওরফে জুয়েল ও জাহেল আল আবেদিন ওরফে রুবেল। তাদের কাছ থেকে এ কে-২২ রাইফেল ছাড়াও উদ্ধার হয়েছে চারটি বিদেশি পিস্তল, একটি বিদেশি রিভলবার ও ৪৭ রাউন্ড বিভিন্ন অস্ত্রের গুলি। সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় অপরাধ সংঘটনের জন্য তারা ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী হিসেবে কাজ করত। চাঁদাবাজি ও হত্যা ছিল তাদের প্রধান কাজ। বিদেশেও এই চক্রের সদস্য রয়েছে। বিদেশ থেকে তাদের দলনেতার নির্দেশ পেলেই তারা মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে হত্যা করাই ছিল তাদের পেশা। ঢাকার বাইরে মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই থেকে দীর্ঘদিন ধরে এই কারবারের নিয়ন্ত্রণ করছে এক শীর্ষ সন্ত্রাসী। তাকে গ্রেফতার করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। আর এই সুযোগে পর্দার আড়ালে অর্থাৎ দেশের বাইরে থেকে তিনি তার সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছেন। গতকাল দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ডিবির যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, খিলগাঁও সিপাহীবাগ এলাকার বায়তুল হুদা মসজিদ সংলগ্ন ২৬৯/এ/ক নম্বর ফাইভ স্টার নিবাস এর সামনে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র ও গুলিসহ তাদের গ্রেফতার করা হয়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে অস্ত্র দিয়ে খুনোখুনির পরিমাণ কমে এসেছে। এমনকি আগের মতো এলাকাভিত্তিক চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীদের যেসব গ্রুপগুলো ছিল, সে সবের শীর্ষ নেতারা  গ্রেফতার হয়েছে। কেউ কেউ পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতও হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি নতুন করে রাজধানীতে অবৈধ অস্ত্রের বিকিকিনি ও মজুদ বাড়ছে বলে তথ্য পাচ্ছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। আগে জঙ্গিরা শুধু বিস্ফোরক বা হাতে তৈরি বোমা ব্যবহার করলেও গত কয়েক বছর ধরে তাদের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের প্রবণতা বেড়েছে। টার্গেট কিলিংয়ের জন্য জঙ্গিরা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করত। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সেমি অটোমেটিক এই রাইফেল এত দিন ব্যবহার হয়েছে, বিভিন্ন দেশের পুলিশ বা ক্যাডেটদের প্রশিক্ষণে। কিন্তু বাজারে আরও আধুনিক প্রশিক্ষণ-রাইফেল চলে আসায় হঠাৎই বাজার হারিয়েছে এই নকল অ্যাসল্ট রাইফেল। তার পরই অস্ত্রের কালোবাজার ছেয়ে গিয়েছে পয়েন্ট টু টু বোরের এই হাল্কা রাইফেলে। নেপাল হয়ে বিহারে ঢুকে দেদার বিকোচ্ছে এ কে-২২। সীমান্ত পেরিয়ে আসে বাংলাদেশে। গুলশনের হামলায় জঙ্গিরা এই রাইফেলই ব্যবহার করেছে। নারায়ণগঞ্জের জঙ্গি ডেরাতেও আইএস পতাকার সঙ্গে এ কে-২২ রাইফেল পায় পুলিশ। বাংলাদেশের জঙ্গিদের হাতে কীভাবে পৌঁছল এ কে-২২? গোয়েন্দারা বলছেন, দেশে সাধারণ দুষ্কৃতকারী থেকে জঙ্গি সবাই অস্ত্র আনে পড়শি দেশ ভারতের বিহার থেকে। কোন পথে এ কে-২২ রাইফেল বাংলাদেশে আসছে, সে বিষয়ে সূত্র জানায়, নেপাল থেকে বিহারে আসা এ কে-২২ পশ্চিমবঙ্গের মালদহ-মুর্শিদাবাদ জেলা হয়ে পৌঁছে যায় বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জে। সেখান থেকেই তা যাচ্ছে জঙ্গিদের হাতে। বাংলাদেশে জঙ্গিদের কাছে এ কে-২২ রাইফেলের ভালো মজুদ রয়েছে বলেও আশঙ্কা গোয়েন্দাদের। অস্ত্র বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, রোমানিয়ায় তৈরি আধা স্বয়ংক্রিয় এ কে-২২ রাইফেল থেকে প্রতি মিনিটে ৫০টিরও বেশি গুলি বেরোয়। এ কে-৪৭-এর নকল করে বানানো এই রাইফেল আমেরিকায় খোলা বাজারেই বিকোয়। দাম শ’তিনেক ডলার। প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহার হয়ে বলে এই রাইফেলের আর এক নাম ‘ট্রেনার’। এমন ভয়ঙ্কর অস্ত্র দেশে ঢুকে মজুদ হতে থাকায় গোয়েন্দাদের ভাবিয়ে তুলেছে। তবে তারা বলছেন, এ কে ২২ রাইফেলের উৎস এবং এর গন্তব্য বের করার চেষ্টা চলছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর