শনিবার, ৩ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

কমছে পানি কাটছে না দুর্ভোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক

কমছে পানি কাটছে না দুর্ভোগ

রংপুরের তারাগঞ্জে বন্যার পর চলছে নদী ভাঙন। ঘরবাড়ি হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়ছে একের পর এক পরিবার -বাংলাদেশ প্রতিদিন

দেশের উত্তরাঞ্চলের সব নদ-নদীর পানি কমলেও দুর্দশা কাটেনি বানভাসিদের। পানিতে ডুবে থাকা বিধ্বস্ত ঘরবাড়িতে ফিরতে পারছে না অনেকেই। আঞ্চলিক সড়ক, কাঁচা রাস্তা নষ্ট হওয়ায় যোগাযোগ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফসলের মাঠ, বীজতলা ডুবে থাকায় মহাসংকটে রয়েছেন কৃষক। গাইবান্ধায় রেলযোগাযোগ গতকালও বন্ধ ছিল। যমুনার পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও বন্যায় প্লাবিত হওয়া ঘরবাড়ি বসবাসের উপযোগী না হওয়ায় বগুড়ার বাসভাসি মানুষ ঘরে ফিরতে পারছে না। প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

লালমনিরহাট : দুই দফায় বন্যায় টানা প্রায় ১৬ দিন পানিতে ডুবে থাকায় বীজতলা পচে নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে আমন ধানের চারার তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে লালমনিরহাটে। চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতেই টানা ভারি বৃষ্টি এবং উজানের পাহাড়ি ঢলে লালমনিরহাটের তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি প্রবাহ ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। দুই দফা বন্যায় জেলার ৫টি উপজেলার শত শত হেক্টর জমির বীজতলা টানা প্রায় ১৫/১৬ দিন ডুবে থাকে। ফলে পচে নষ্ট হয় কৃষকের আমন বীজতলা। বন্যার পানি নেমে গেলে আমন ধান চাষে মাঠে নেমে পড়ে জেলার কৃষকরা। কিন্তু চারা গাছ নষ্ট হওয়ায় জেলাব্যাপী চারার সংকট দেখা দিয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় কোনো বীজতলা অবশিষ্ট নেই। ফলে চাষিরা তুলনামূলক উঁচু অঞ্চলে ছুটছেন আমনের চারা সংগ্রহে। জেলার ৫টি উপজেলার প্রায় অধিকাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতা ও বন্যায় বীজতলা নষ্ট হওয়ায় আমনের চারার দামও বেড়েছে কয়েকগুণ। আমন চারা অনেক কৃষকের নাগালের বাইরে রয়েছে। অপরদিকে ধানের বাজার দাম কম থাকায় বেশি বিনিয়োগ করতেও হিমশিম খাচ্ছেন কৃষকরা। হাতীবান্ধা উপজেলার পারুলিয়া এলাকার চাষি মনোয়ার হোসেন  জানান, ১০ দোন জমির জন্য করা আমনের বীজতলা বন্যায় নষ্ট হয়েছে। চারা গাছ কিনে মাত্র দুই দোন জমিতে আমন ধান রোপণ করেছেন, বাকি ৮ দোন জমি তার ফাঁকা পড়ে রয়েছে। সিরাজগঞ্জ : তিন সপ্তাহে বন্যায় ও নদীভাঙনে সিরাজগঞ্জের ৪০৮ গ্রামের ৮৫ হাজার ৫৫০টি পরিবার বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৩ হাজার ৭৯ পরিবার সম্পূর্ণ ও ৮২ হাজার ৪৭১টি পরিবার আংশিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন অফিসের সূত্রে জানা গেছে, জেলার কাজিপুর, সিরাজগঞ্জ সদর, বেলকুচি,  চৌহালী ও শাহজাদপুর ৫টি উপজেলার ৪১টি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে। দুই দফা বন্যায় ১৫ হাজার ৪৩৪ জন সম্পূর্ণ ও ৩ লাখ ১৩ হাজার ৯৯৭ জন মানুষ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যার পানিতে পড়ে মারা গেছে ৫ জন। ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ির সংখ্যা মোট ৫০ হাজার ৫১৮টি। এর মধ্যে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ৬ হাজার ৫০৫ এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ৪৪ হাজার ১৩টি। বন্যার পানিতে ডুবে ও বিভিন্ন রোগে মারা গেছে ৪টি গবাদি পশু ও ৩ হাজার ৮৮৫টি হাঁস-মুরগি। ৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে, আংশিক ক্ষতি হয়েছে আরও ২৫৬টি শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের। ৫৫.৩৪ কিলোমিটার পাকা ও কাঁচা সড়ক সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। আংশিক নষ্ট হয়েছে আরও ১৮০ কিলোমিটার সড়কের। অধিকাংশ কাঁচা ও পাকা রাস্তা এখনো বন্যার পানিতে নিমজ্জিত। এসব সড়কের ২৯টি ব্রিজ ও কালভার্টও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়াও জেলার ২১ হাজার হেক্টর জমির ফসল বন্যার পানিতে ডুবে যায়। প্রায় ১৪ হাজার হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসল সম্পূর্ণ ও আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জেলায় প্রায় ১৪৩  কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়েছে। এ ছাড়াও জেলার প্রায় দশ হাজার তাঁত নষ্ট হয়ে গেছে। কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে নেমে গেছে ধরলা ও ব্রহ্মপূত্র নদের পানি। ঘরে ফিরতে শুরু করছে বন্যা কবলিতরা। বসতবাড়ি ডুবে থাকায় বেহাল অবস্থা হয়েছে বাড়ি-ঘরের। বন্যার প্রবল স্রোতে ঘরের বেড়া, ল্যাট্রিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘরের ভিতর এক হাঁটু কাদা। নষ্ট হয়ে গেছে রান্না করার চুলা। জ¦ালানি সংকটের কারণে রান্না-বান্না করতে পারছে না। উঁচু স্থানে গবাদিপশু রাখলেও গো-খাদ্যের অভাবে গৃহস্থরা চিন্তায় পড়েছেন। কেউ কেউ বাড়িঘর পরিষ্কার করে মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করে নিয়েছে। তবে কারও কারও ঘর ব্যবহার অনুপযোগী হওয়ায় আবারও ফিরে গেছেন সড়কে। ফলে বন্যা পরবর্তী দুর্দশার মধ্যে পড়েছে তারা। জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা যায়, বন্যার ফলে ৫৬টি ইউনিয়নের ৪৯৮টি গ্রাম পানিবন্দী হয়ে পড়ে। এতে ১ লাখ ৫২ হাজার ৪০০ পরিবারের ৬ লাখ ৯ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেড় লাখ ঘরবাড়ি। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও প্রায় ৫ হাজার মানুষ। বন্যায় ৩২ কিলোমিটার বাঁধ, ৭২ কিলোমিটার কাঁচা ও ১৬ কিলোমিটার পাকা রাস্তা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ২ লাখ ৩৯ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নলকূপের ক্ষতি হয়েছে সাড়ে ৯ হাজার, ৪১৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আংশিক এবং ২টি সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ফসলের ক্ষতি হয়েছে ১৫ হাজার ১৬০ হেক্টর। জেলার ২১টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ৪ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। গাইবান্ধা : এবারের ভয়াবহ বন্যায় গাইবান্ধায় কৃষিতে মারাত্মক বিপর্যয় এনেছে। প্রায় ২০ দিন ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে থাকায় ফসল বিনষ্ট হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এবারের বন্যায় জেলায় ১৪ হাজার ২১ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে ৫ হাজার ৫২০ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ এবং ৮ হাজার ৫০১ হেক্টর জমির ফসল আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টাকার অঙ্কে এ ক্ষতির পরিমাণ ৯২ কোটি ১ লাখ ১৭ হাজার। এদিকে গত ১৬ জুলাই থেকে টানা ১৯ দিন ঢাকার সঙ্গে গাইবান্ধার রেল যোগাযোগ বন্ধ আছে। গতকাল রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন এই রেলপথের মেরামত কাজ পরিদর্শন করতে গাইবান্ধা আসেন।  সেখানে তিনি জানান, যদি আর কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা না দেয় তবে আমরা আশা করছি ঈদের আগেই ৮ জুলাই এই পথে ট্রেন চলাচল শুরু হবে। বগুড়া : বগুড়ায় যমুনা নদীর পানি দ্রুত কমায় সারিয়াকান্দি উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে ঘরবাড়ি বসবাসের উপযোগী না হওয়ায় বানভাসি মানুষ ঘরে ফিরতে পারছে না। বগুড়া জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আজাহার আলী ম ল জানান, জেলায় বন্যাজনিত কারণে ৮ জনের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সারিয়াকান্দি উপজেলায় সাপে কেটে ১ জন, সোনাতলায় ৩ জন ও গাবতলী উপজেলায় এবং ধুনট উপজেলায় ১ জন পানিতে ডুবে মারা গেছেন। সব মিলিয়ে বন্যায় এখন পর্যন্ত ২৫ হাজার ৩৮৯ হেক্টর ক্ষেতের ফসল নষ্ট হয়েছে।  বাঙালি নদীর পানিতে সৃষ্ট বন্যায় এখন পর্যন্ত জেলার ৬টি উপজেলার ৫৯টি ইউনিয়নের মধ্যে ৪৩ ইউনিয়ন ও ৩টি পৌরসভার ৩৭৭ গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৩ লাখ ৩৩ হাজার মানুষ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। প্রায় ৬ হাজার ঘরবাড়ির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সর্বশেষ খবর