শনিবার, ৩ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

সুদিন ফিরতে পারে বেতশিল্পে

শাহ্ দিদার আলম নবেল, সিলেট

সুদিন ফিরতে পারে বেতশিল্পে

দোকানে সাজানো বেতের তৈরি আসবাবপত্র -বাংলাদেশ প্রতিদিন

সিলেটের ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বেত। স্বর্ণযুগ পেছনে ফেলে বেতশিল্প এখন লড়াই করছে টিকে থাকতে। অমিত সম্ভাবনার এ শিল্প ধুঁকছে নানা সমস্যায়। এক সময় বৃহত্তর সিলেটজুড়ে বেতশিল্পের যে ঝঙ্কার ছিল, তা এখন ম্রিয়মাণ। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়ামসহ নানা ধরনের শিল্পের প্রসার বেতশিল্পকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। তবে বেতশিল্পের সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ঘুরে দাঁড়ানোর সব রসদই আছে এ শিল্পে। বর্তমান অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে অপার সম্ভাবনার নতুন এক দিগন্ত খুলতে পারে এ শিল্প। যে সম্ভাবনায় রপ্তানিপণ্যের তালিকায় নতুন করে নাম লেখাতে পারে বেতশিল্প। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এত সব সংকটের মধ্যেও বেতশিল্পের সম্ভাবনা হারিয়ে যায়নি। বেতশিল্পের প্রতি সরকার মনোযোগ দিলে পাল্টে যাবে এর কঠিন অবস্থা। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বেতশিল্প অপার সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত খুলতে পারে। তারা বলছেন, সরকারি উদ্যোগে সিলেটের বিভিন্ন বনাঞ্চলে যদি বেতের চাষ করা হয় এবং সেগুলো বেতশিল্পে জড়িত ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা হয়, তবে এ শিল্পে কাঁচামাল সংকটও কেটে যাবে। তখন আর বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করতে হবে না। ফলে বেতের তৈরি আসবাবের দামও কমে যাবে। একই সঙ্গে বেতের পণ্যের যথাযথ বাজারজাত এবং প্রচারের বিষয়টিতে নজর দেওয়ার কথাও বলছেন বেতশিল্পীরা। তারা বলছেন, বেতশিল্পকে রক্ষায় সরকারি উদ্যোগের সঙ্গে বেসরকারি কোম্পানিগুলোও যদি বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে আসে, তবে হারানো সুদিন ফিরে পাওয়া সম্ভব। পরিবেশবান্ধব পণ্য হিসেবে বেতের তৈরি জিনিসপত্রকে ব্র্যান্ডিং করা গেলে বিশ্বজুড়ে এটি ব্যাপক হারে গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারে। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা জানান, এক সময় সিলেট থেকে বেতের তৈরি বিপুল পরিমাণ ফার্নিচার ও শৌখিন সামগ্রী বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হতো। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হতো মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। ইউরোপ-আমেরিকায়ও এর কদর কম ছিল না। সিলেটিরা বিভিন্ন দেশে বেতের ফার্নিচারের শোরুম খুলেও ব্যবসা করছিলেন। বেতের সুদিন ফিরলে বিদেশের মাটিতে আবারও এ শিল্পের প্রসার ঘটানো সম্ভব। এতে রপ্তানি আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে আশাবাদী তারা।

জানা যায়, প্রায় ২০০ বছর আগে সিলেটের ঘাসিটুলা এলাকার কয়েকজন যুবক ভারতে গিয়ে বেতশিল্পের কারুকাজ শিখে এসেছিলেন। তাদের হাত ধরে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে বেতের তৈরি নানা ধরনের আসবাব। সিলেট ছাড়িয়ে গোটা দেশেই ছড়িয়ে পড়ে বেতের আসবাবপত্র। একপর্যায়ে তা বিদেশেও রপ্তানি শুরু হয়। ভারত ঘুরে আসা ওই যুবকদের কাছ থেকে আরও অনেকেই বেতের আসবাবপত্র তৈরির কাজ শেখেন। শুধু ঘাসিটুলাই নয়, সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক ও দিরাই, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল প্রভৃতি এলাকায় বেতশিল্পের প্রসার ছিল। জানা যায়, প্রায় এক যুগ আগেও উজ্জ্বল ছিল বেতশিল্প। সুরমা নদীর তীরবর্তী ঘাসিটুলায় সহস্রাধিক বেতশিল্পী ছিলেন। বেত দিয়ে তৈরি তাদের ফার্নিচার, শৌখিন পণ্যের সুনাম ছিল সারা দেশে। বেতের আসবাবপত্রের বিপণনের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র ছিল হজরত শাহজালাল (রহ.) মাজার এলাকা। সিলেটে আসা পর্যটক কিংবা ধর্মানুরাগীরা এখান থেকে বেতের খাট, সোফা, চেয়ার, টেবিলসহ নানা ধরনের আসবাব কিনে নিয়ে যেতেন। তুলনামূলকভাবে এসব পণ্যের দাম ছিল সস্তা। একসময় সিলেটের হরিপুর, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, সুনামগঞ্জের ছাতক, জাউয়া, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল, হবিগঞ্জের চুনারুঘাট প্রভৃতি এলাকার বন-জঙ্গলে ‘গল্লা’ ও ‘জালি’ নামক বেত প্রাকৃতিকভাবেই হতো। কিন্তু বন-জঙ্গল উজাড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে বেতও। এভাবে বেত ধ্বংস হয়ে পড়লেও নতুন করে এগুলো সৃজন করা হয়নি। দেশে বেতের সংকট থাকায় বর্তমানে ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার ও ভারত থেকে স্বল্প পরিমাণে বেত আমদানি করা হয়। এতে করে বেতশিল্পে ব্যয় বেড়েই চলেছে। বেতের তৈরি আসবাবপত্রের দামও বেড়েছে। ফলে প্লাস্টিক পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না বেতশিল্প। বেতশিল্পের কারিগর জামিল আহমদ বলেন, এখন বেতশিল্পে কাঁচামালের ব্যাপক সংকট রয়েছে। বেড়েছে শ্রমিকদের মজুরিও। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে বেতের তৈরি আসবাবপত্রের দামও। সিলেটের বেতের ফার্নিচার ব্যবসায়ী ওলিউর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের পক্ষে মানসম্মত পণ্য উৎপাদন, প্রচার-প্রচারণা ও প্রদর্শনী সম্ভব হয় না। বেতশিল্পে বড় উদ্যোক্তা এগিয়ে এলে অভ্যন্তরীণ বাজার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, বেতশিল্পের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। কুটিরশিল্প হিসেবে বেতকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি ভর্তুকি প্রয়োজন। দীর্ঘ মেয়াদে সহজ শর্তে এবং স্বল্প সুদে উদ্যোক্তাদের ঋণও দেওয়া প্রয়োজন। সিলেট মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি আবদুল জব্বার জলিল বলেন, বেতশিল্পের সবচেয়ে বড় সমস্যা কাঁচামালের সংকট। বন বিভাগের উদ্যোগে বেতবাগান সৃজন করা গেলে সংকট কমবে। এতে বেতশিল্পীরা তাদের আদি পেশা ধরে রাখবেন এবং এগিয়ে নেবেন এ শিল্পকে।

সর্বশেষ খবর