রবিবার, ৪ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

পার্টটাইম চাকরির ফুল টাইম ফাঁদ

মির্জা মেহেদী তমাল

পার্টটাইম চাকরির ফুল টাইম ফাঁদ

‘আপনি কি ছাত্র? পার্টটাইম চাকরি খুঁজছেন? চলে আসুন আমাদের অফিসে? সপ্তাহে মাত্র ৩ ঘণ্টা ডিউটি! মাসিক বেতন ন্যূনতম সাড়ে ৫ হাজার টাকা।’ বাসের সিটে বসেই লিফলেটে এমন একটি বিজ্ঞাপনের ওপর চোখ রাখলেন সাইফুল ইসলাম। লিফলেটটি হাতে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন। তিনি এমন একটি চাকরি খুঁজছিলেন অনেক দিন ধরেই। সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করতে মন চাচ্ছে না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র সাইফুলের। বাস থেকে নেমেই তিনি যোগাযোগ করেন বিজ্ঞাপনের নিচে দেওয়া মোবাইল নম্বরে। ওপাশ থেকে তাকে বলা হয় ফকিরাপুল পানির ট্যাংকির কাছে এসে এই নম্বরে ফোন দিতে। সাইফুল তখনই চলে গেলেন সেখানে। ফোন দিলেন। একটি ছেলে এসে তাকে নিয়ে যায় দুটি চেয়ার, দুটি টেবিল, একটি ফ্যানসর্বস্ব এক রুমের অফিসে। সেখানে বসা তিনজন। এক মাসের মধ্যে চাকরি হবে- এমন প্রতিশ্রুতি দিলেন তিনজনের একজন। বললেন, পার্টটাইম জবের জন্য মানুষ পাগল। আপনাদের মতো ছাত্র, যুবক বা বেকারদের জন্য এ সুযোগ করে দিয়েছি। আপনাকে আগে সদস্য হতে ২ হাজার টাকা দিতে হবে। প্রথমে কথাগুলো শুনে ভালো লাগলেও টাকার কথা শুনে সাইফুলের চেহারা মলিন হয়ে যায়। এর পরও তিনি পার্টটাইম সেই চাকরির জন্য পকেটে থাকা পুরো মাসের খরচ দিতে রাজি হলেন। তিনি ২ হাজার টাকা অ্যান্ট্রি ফি দিলেন। ঠিক এক মাস পর তাকে যোগাযোগ করার জন্য বলেন ওই ব্যক্তি। তিনি যোগাযোগ করেন। বলা হয় আরও ৫০০ টাকা দিতে। সাইফুল আবারও ৫০০ টাকা দেন। চাকরি পেতে আরও এক মাস অপেক্ষা করতে হবে। পরের মাসে আবার ফোন করলে দেখা যায় মোবাইল বন্ধ। সাইফুলের মন খারাপ হয়। তিনি সোজা চলে যান সেই অফিসে। গিয়ে দেখতে পান আগের লোকজন সেখানে আর নেই। সেই অফিসে তিনটি চৌকি। মেস হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়েছে রুমটি। সাইফুল বুঝতে পারেন, তিনি প্রতারিত হয়েছেন। কাঁকন নামে এক যুবক এমন একটি অফিসের ঠিকানায় ফোন দিয়ে নিজেকে চাকরিপ্রার্থী পরিচয় দেন। অফিসের কর্মকর্তা বাপ্পীর কাছে ঠিকানা জানতে চাইলে তাকে শ্যামলী বাসস্ট্যান্ডে এসে ফোন দিতে বলেন। সঙ্গে আনতে হবে এসএসসির সনদ এবং দুই কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি। কোনো টাকা-পয়সা লাগবে কিনা? এ প্রশ্নের উত্তরে বাপ্পী জানান, ‘আপনি মাসে মাসে ৭-৮ হাজার টাকা বেতন পাবেন। আর চাকরি পেতে কিছু টাকা খরচ করবেন না! প্রথমে চাকরিপ্রার্থী হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে লাগবে ২ হাজার টাকা। এরপর আর কোনো টাকা দিতে হবে না। অ্যান্ট্রি হওয়ার পরদিনই চাকরির গ্যারান্টি দিলেন বাপ্পী। তিনি জানান, তাদের প্রতিষ্ঠান চালান রুবেল আহমদ নামে এক ব্যক্তি। তার অধীনে চার-পাঁচ জন শিক্ষক আছেন। নগরীর বিভিন্ন জায়গায় তাদের একাধিক শাখা আছে। নানা কারণে এসব শাখার ঠিকানা গোপন করে রাখা হয়। ‘অভিজ্ঞতার দরকার নেই, কোনো জামানতের দরকার নেই। প্রয়োজন নেই শিক্ষাগত যোগ্যতারও। তবু পার্টটাইম চাকরি দেওয়া হবে দেশের স্বনামধন্য সুপ্রতিষ্ঠিত কোম্পানি এসএল গ্রুপের এসএল কোম্পানির ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ে।’ নগরীর মিরপুর দক্ষিণ মণিপুরের বাসিন্দা নূর গনি বিশ্বাস নামের এক ভুক্তভোগী জানান, ‘২০১৭ সালের মার্চে দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর একটি প্রতিষ্ঠানে ১ হাজার টাকা দিয়ে তিনি সদস্য হন। টাকা দেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে চাকরির কথা বলা হয়। এক সপ্তাহ পর যোগাযোগ করলে চাকরিতে যোগদানের জন্য এককালীন ১০ হাজার টাকা চাওয়া হয়। এজন্য নেওয়া হয় তিন দিন ক্লাস। প্রতি ক্লাসের জন্য ফি নেওয়া হয় আবার আড়াই শ টাকা করে। এক মাস পর অনেকের টাকা নিয়ে এ প্রতিষ্ঠান কেটে পড়ে। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আরএস গার্মেন্টস নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগপত্রও দেওয়া হয়। সাভারের ঠিকানায় গিয়ে এ প্রতিষ্ঠানই আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। দেখা গেছে, একই প্রতিষ্ঠান একাধিক মোবাইল নম্বর ব্যবহার করে এ প্রতারণা করছে। সম্প্রতি বিভিন্ন স্থানে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে এ চক্রের অফিস। বড়জোর দু-তিন মাস পরপর নগদনারায়ণ হাতিয়ে নিয়ে হাওয়া হয়ে যায় এসব প্রতিষ্ঠান। বেকার ও শিক্ষার্থীদের ধারদেনার টাকা হাতিয়ে দীর্ঘশ্বাস পুঁজি করে প্রতারক চক্র আঙ্গুল ফুলে রাতারাতি কলাগাছ হচ্ছে।

সর্বশেষ খবর