বুধবার, ৭ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

ইসলামের পবিত্র স্থান দর্শন ও আল্লাহর ইবাদতে ব্যস্ত মুসল্লিরা

মোস্তফা কাজল, (মক্কা) সৌদি আরব থেকে

ইসলামের পবিত্র স্থান দর্শন ও আল্লাহর ইবাদতে ব্যস্ত মুসল্লিরা

সারা বিশ্বের ১৫২ মুসলিম অধ্যুষিত দেশ থেকে প্রায় ২৬ লাখ হজপ্রত্যাশী মুসল্লির ঢল এখন মক্কা ও মদিনায়। পবিত্র হজ শুরু হতে এখনো মাত্র এক দিন বাকি। এরই মধ্যে পবিত্র নগরীতে আসা হজযাত্রীরা নামাজ আদায়ের পাশাপাশি ইসলামের ঐতিহাসিক স্থানগুলো পরিদর্শন করে তাদের ব্যস্ত সময় পার করছেন। মক্কায় যারা আগে আসছেন তারা হারাম এলাকার কাছেই জাবালে নূর বা হেরা পর্বত দেখতে ছুটছেন। আবার অনেকে মসজিদুল কিবলা, উহুদের পাহাড় দেখেছেন। এর মধ্যে জাবালে নূর পর্বতে ওঠা-নামা করা যে কত কঠিন। তা যিনি ওঠেননি, তিনি বুঝবেন না। অথচ নবী করিম (সা.) এই পর্বতে ওঠা-নামা করেছেন নিয়মিত। জাবালে নূর পাহাড়ে উঠতে সময় লাগে সোয়া এক ঘণ্টা থেকে দেড় ঘণ্টা। নামতে লাগে আধা ঘণ্টা থেকে পৌনে এক ঘণ্টা। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) যেখানে আল্লাহর ধ্যান করতেন এবং পবিত্র কোরআন শরিফের আয়াত যেখানে নাজিল হয়েছে। সেসব জায়গা দেখতে পাওয়া সৌভাগ্যের বিষয়। এই সৌভাগ্য এ বছর কয়েক লাখ মুসল্লির হয়েছে।

এসব ইসলামিক স্থান দেখতে মুসল্লিরা বেরিয়ে পড়ছেন ফজরের নামাজের পর। হেরা গুহায় সকালে আর বিকালে যাওয়া যায়। অনেকে জোহরের নামাজ আদায় করে দুপুরের খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়েন। অনেকে ট্যাক্সি নিয়ে উঁচু-নিচু আঁকাবাঁকা সড়ক দিয়ে তিন-চারটি বিশাল সুড়ঙ্গপথ পার হয়ে ১৫ মিনিটের মধ্যে জাবালে নূরের পাদদেশে পৌঁছে যান। আরবিতে জাবাল মানে পাহাড়। তাই এ পাহাড়কে নূরের পাহাড়ও বলা হয়। পাহাড়ে ওঠার আগ পর্যন্ত আনুমানিক ১৫০ মিটার পাকা সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। কিছু গাড়ি সে পর্যন্ত যায়। এ পাকা সড়কের পর শুরু হয়েছে পাহাড় কেটে তৈরি সিঁড়ির ধাপ। যেখানে সাইনবোর্ডে লেখা আছে জাবালে নূর বা গারে হেরার উচ্চতা ৫৬৫ মিটার অর্থাৎ অর্ধকিলোমিটারের বেশি উচ্চতা। এ পাকা সড়ক পর্যন্ত রাস্তার পাশে দোকানপাট, বাড়িঘর গড়ে উঠেছে। দোকান থেকে পানির বোতল আর হালকা খাবার চাইলে কেনা যায়। এখানে অনেক বাংলাদেশি মুসল্লির সমাগম হয়। পাহাড় বেয়ে একটু ওপরে একটি দোকানে জসিম নামে বাংলাদেশের এক কর্মী কাজ করেন। তার কাছে জানলাম পাহাড়ের চূড়ায় ওঠা পর্যন্ত ২২টি দোকান রয়েছে। ১৭টিতে বাংলাদেশের কর্মী রয়েছেন। বাংলাদেশিরা সবাই মিলে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছেন। দুপুর ১টায় আমি পাহাড়ে উঠতে শুরু করি। আমার গাইড জসিম। সিঁড়ি এঁকেবেঁকে ওপরে উঠে গেছে। কিছু কিছু জায়গায় যেখানে সিঁড়ি বেশ খাড়া সেখানে রেলিং আছে। জসিম জানান, এ সিঁড়িপথ চার বছর আগে নতুন তৈরি করা হয়েছে। আগে ছিল না। তাই এখন ওপরে ওঠা আগের তুলনায় সহজ হয়েছে। কিছু দূর উঠে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বসার জায়গা তৈরি করা হয়েছে। পথে এ রকম পাঁচটি বিশ্রামাগার চোখে পড়ল। এক দল লোক আছে, যাদের দেখলে মনে হবে তাঁরা রাজমিস্ত্রি। বালু, সিমেন্ট নিয়ে এমনভাবে অপেক্ষা করছেন, যেন আপনি সিঁড়ির ধাপটিতে ওঠার পর তিনি মেরামতের কাজ শুরু করবেন। কিন্তু তাঁরা তা করছেন না। এঁরাও মানুষের কাছে হাত পাতেন। পথে পানি, চা, ঠা া পানীয় বিক্রি হচ্ছে। চায়ের দোকান ও বিশ্রাম কেন্দ্রগুলো বেশিরভাগ পাকিস্তানিদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত। পথের ধারে অসংখ্য খালি পানির বোতল ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। পাহাড়ে উঠতে উঠতে মনে হচ্ছিল, যখন কোনো রাস্তাঘাট ছিল না তখন কেমন করে নবীজি (সা.) দীর্ঘদিন এ পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত গুহায় যাতায়াত করেছেন। হজরত খাদিজা (রা.)-ই বা কেমন করে নবীজি (সা.)-এর জন্য এখানে খাবার নিয়ে উঠতেন! পথে চার জায়গায় সাইনবোর্ডে ওপরের দূরত্ব ও পরবর্তী বিশ্রামাগার কত দূরে এসব তথ্য দেওয়া আছে। কিছু দূর উঠে আমরা বিশ্রাম নিই। ওপরে উঠতে সময় লেগেছে প্রায় দেড় ঘণ্টা। আমি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সময় সিঁড়ির সংখ্যা গোনা শুরু করেছিলাম। আমার হিসাবে সিঁড়ির সংখ্যা এক হাজার ৯৫টি। তার পর যাওয়া হয় জাবালে সাওর। এটি কাবা শরিফ থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত। জাবাল মানে পাহাড়। সাওর অর্থ গুহা। মক্কা থেকে মদিনায় যাওয়ার পথে শত্রুর হাত থেকে বাঁচতে হজরত আবু বকর (রা.)-কে নিয়ে সাওর পর্বতের গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন নবীজি (সা.)। তিন দিন তিন রাত তাঁরা এই গুহায় কাটিয়েছেন। শত্রুরা খুঁজতে খুঁজতে চলে গিয়েছিল গুহার খুব কাছে। কিন্তু গুহামুখে মাকড়সার জাল দেখে ফিরে যায় তারা। এই তথ্য আমাদের অনেকেরই ছোটবেলায় জানা থাকার কথা। এখানে একটি বড় সাইনবোর্ডে দর্শনার্থীদের পর্বতে উঠতে নিষেধ করা আছে। লেখা আছে, এই পর্বতে আরোহণ করার মধ্যে কোনো অতিরিক্ত সওয়ার বা মর্তবা নেই। এরপর সুযোগ পেলে হজে আসা অনেকে ছুটে যান, জান্নাতুল মা’আলা (কবরস্থান), মসজিদে জিন নামের ঐতিহাসিক ইসলামিক স্থাপনা দেখতে। জান্নাতুল মা’আলা মসজিদুল হারামের পূর্ব দিকে। মক্কা শরিফের বিখ্যাত কবরস্থান। এখানে কোনো কবর বাঁধানো নয়। নামফলকও নেই। মোনাজাত করলাম নিজের মতো করে। কেউ একজন বললেন, এই কবরস্থানে রয়েছে বিবি খাদিজা (রা.)-এর কবর। হজ করতে এসে কেউ মারা গেলে আগে এখানে কবর দেওয়া হতো। এখন স্থান সংকুলান না হওয়ায় শারায়া কবরস্থানে দাফন করা হয়। প্রবেশমুখ পার হলেই অপেক্ষা করার জায়গা আছে। নারীদের কবরস্থানে প্রবেশ নিষেধ। তাই এখানে বসে তাঁরা দোয়া করেন। জান্নাতুল মা’আলা কবরস্থানের কাছে মসজিদে জিন। সহিহ হাদিস থেকে জানা যায়, জিনেরা এখানে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে একাধিকবার এসেছে। সুন্দর মসজিদ, এখানে নামাজ আদায় করেন হজে আসা মুসল্লিরা। এরপর মক্কা উম্মুল জুদ এলাকায় কাবার গিলাফ তৈরির কারখানা। সেখানে অনেক বাংলাদেশি চাকরি করেন। কাবা শরিফের কাছে উমরা মসজিদে যাওয়ার পথেই পড়ে মক্কা জাদুঘর। কোনো প্রবেশ ফি নেই। জাদুঘরে আছে সৌদি আরবের প্রাচীন সংস্কৃতির সব নিদর্শন। পোশাক-পরিচ্ছদ। আসবাবপত্র ও বাদ্যযন্ত্র। আছে আরবি বর্ণমালা বিবর্তনের নিদর্শন। এক কোনায় রয়েছে পানির কূপ। কূপ থেকে পানি তোলার যন্ত্রপাতি। পাশের কক্ষে আছে প্রাচীন ধাতব মুদ্রার সংগ্রহশালা। মুগ্ধ হওয়ার মতো বেশ কিছু আরবি ক্যালিগ্রাফি আছে একটি কক্ষে। প্রতিটি কক্ষেই পাহারাদার আছেন। তাঁদের অনেকেই বাংলাদেশি। রয়েছে হাতে লেখা পবিত্র কোরআন শরিফ। হজরত উসমান (রা.)-এর আমলের কোরআন শরিফও আছে এই জাদুঘরে। আরও আছে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সম্পূর্ণ বংশ তালিকা। আছে কুরাইশসহ আরবের বিখ্যাত গোত্র ও বংশের পরিচয়।

সর্বশেষ খবর