শনিবার, ১৭ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

নকল বৈদ্যুতিক পণ্যে সয়লাব বাজার

সক্রিয় নয় সিন্ডিকেট অধিকাংশ অগ্নিকান্ডের জন্য দায়ী নিম্নমানের বৈদ্যুতিক পণ্য

শামীম আহমেদ

বিদ্যুৎ খাতে বর্তমান সরকারের অভূতপূর্ব সাফল্যকে অভিশাপে পরিণত করেছে বাজার ছেয়ে যাওয়া নকল বৈদ্যুতিক সামগ্রী। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে প্রতিনিয়ত মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি একের পর এক ভয়াবহ অগ্নিকা-ের পেছনে উঠে আসছে নকল ও নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের কথা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বাজারে ৪০ শতাংশের বেশি বৈদ্যুতিক পণ্যই নকল ও নিম্নমানের। ভালো কোম্পানিগুলোর পণ্য হুবহু নকল করে ছাড়া হচ্ছে বাজারে। অনেকে প্রতিষ্ঠিত বৈদ্যুতিক পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের চাকরি ছেড়ে সেই অভিজ্ঞতা থেকে দিয়েছেন নকল কারখানা। দেশের বাইরে থেকেও আসছে নিম্নমানের পণ্যের একটা বড় অংশ। এগুলো কিনে গ্রাহক শুধু আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তই হচ্ছেন না, সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন মৃত্যুর ফঁাঁদ। ফায়ার সার্ভিসের হিসাবে সাম্প্রতিক অগ্নিকা গুলোর ৭৫ থেকে ৮০ ভাগের পেছনে দায়ী বিদ্যুৎ।

২০১৪ সালে এই হার ছিল ৫৫-৬০ শতাংশ। ৫ বছরে বিদ্যুৎ থেকে অগ্নিকাে র হার বেড়েছে ১৫ শতাংশের বেশি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এক দশকে সারা দেশে ১ লাখ ৬৮ হাজার ১৮টি আগুনের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৮ সালেই ঘটেছে ১৯ হাজার ৬৪২টি, যার মধ্যে ঢাকাতেই ঘটে ২ হাজার ৮৮টি। নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার বন্ধ করতে পারলে এসব দুর্ঘটনার বড় অংশই এড়ানো যেত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্র্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. জহুরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আগুনের ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, বিদ্যুৎ থেকে অধিকাংশ অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত আর্কিং বা স্ফুলিঙ্গের কারণে। নিম্নমানের তার ও বিদ্যুৎ পণ্যে এটা হয়। এসব পণ্যে কপার কম থাকায় কাক্সিক্ষত বিদ্যুৎ প্রবাহ নিতে পারে না। গরম হয়ে স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করে। প্লাস্টিকের আবরণ গলে নেগেটিভ-পজেটিভ এক হয়ে শর্ট সার্কিট হয়। আবার দুই তারের মাঝে বিদ্যুৎ অপরিবাহী আস্তরণ সঠিক মাত্রায় না থাকায়ও আর্কিং হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, দুর্ঘটনায় বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্নকারী সার্কিট ব্রেকার পুড়ে গেছে, কিন্তু বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়নি। নি¤œমানের ও লোড অনুযায়ী পণ্য বাছাই না করায় এটা হচ্ছে। ইলেকট্রিক্যাল ডিজাইনার দিয়ে সঠিক পণ্য বাছাই করলে দুর্ঘটনা অনেকটাই কমে যেত। বিএসটিআইর তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশে ১৮টি প্রতিষ্ঠানের কেবল, ৮টি প্রতিষ্ঠানের সুইচ-সকেট, ৩৮টি প্রতিষ্ঠানের ফ্যান তৈরির লাইসেন্স রয়েছে। অন্যান্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম তৈরির লাইসেন্স রয়েছে আরও ২২টি প্রতিষ্ঠানের। অনুসন্ধানে জানা গেছে, লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠানের বাইরে সহস্রাধিক কারখানায় নকল পণ্য তৈরি হয়ে সারা দেশের বাজারে ছড়িয়ে পড়ছে। কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা, ঢাকার নবাবপুর রোড, সিদ্দিকবাজার, আলুবাজার, ডেমরা ও শ্যামপুরের অলিগলিতে গড়ে উঠেছে এমন অনেক কারখানা। নকল তারের বেশিরভাগই তৈরি হচ্ছে দেশে। অন্যান্য পণ্য বেশি হচ্ছে আমদানি। গত ২৭ জানুয়ারি রাজধানীর সিদ্দিকবাজার ও আলুবাজারে অভিযান চালিয়ে পাঁচটি অবৈধ কারখানা ও চারটি গোডাউন সিলগালা করে র‌্যাব। জব্দ করে সাতটি প্রতিষ্ঠিত কোম্পানির মোড়ক ও লোগো নকল করে বানানো বিপুল পরিমাণ তারসহ প্রায় চার কোটি টাকা মূল্যের বৈদ্যুতিক পণ্য।

এসব নকল পণ্য তৈরির সঙ্গে জড়িতদের অনেকেই এক সময় বৈদ্যুতিক পণ্য প্রস্তুতকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিতে চাকরি করেছেন। জানা গেছে, আমদানি পর্যায়ে চীনের গোয়াংজু থেকে আসছে অধিকাংশ নিম্নমানের বৈদ্যুতিক পণ্য। এই বাজার নিয়ন্ত্রণ করে স্টেডিয়াম ও নবাবপুর এলাকার ছয়টি সিন্ডিকেট। চট্টগ্রামে আছে আরও তিন সিন্ডিকেট। তারা গোয়াংজুতে বাংলাদেশি এজেন্টদের কাছে এখানকার ভালো কোম্পানির পণ্যের নমুনা পাঠায়। হুন্ডির মাধ্যমে যায় টাকা।

 এজেন্টরা বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে নির্দিষ্ট দামের মধ্যে ওই পণ্যের নকল তৈরি করে। এরপর সব সিন্ডিকেটের মাল একত্র করে বাংলাদেশে পাঠায়। রাজধানীর কয়েকটি ইলেকট্রিক মার্কেট ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন দোকানে বিক্রি হওয়া বৈদ্যুতিক তার, চার্জার লাইট, ফ্যান, সিএফএল বাল্ব, মাল্টিপ্লাগ, সুইচ, সকেটসহ বিভিন্ন ইলেকট্রিক পণ্যের একটা বড় অংশেই নেই কোনো কোম্পানির নাম বা বিএসটিআইর লোগো। মাঝে মধ্যে অভিযান চালিয়ে কিছু নকল কারখানার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও খুচরা বাজারে এসব পণ্যের সরবরাহ ও বিক্রি থামছে না। বিএসটিআইর উপপরিচালক (সিএম) রিয়াজ উদ্দিন বলেন, নকল কারখানার তথ্য পেলেই অভিযান চালাচ্ছি। গত নয় মাসে ঢাকায় ১০টি নকল কারখানাকে তিন লাখ টাকা জরিমানা করেছি। ৫ কোটি টাকা মূল্যের নকল তার ধ্বংস করেছি। সারা দেশেই অভিযান চলছে। ইলেকট্রিক পণ্যের এত বড় বাজার মনিটরিং করা কঠিন। নকল পণ্যগুলো এত সূক্ষ্মভাবে তৈরি হচ্ছে যে, বাজারে গেলে আমরাও বিভ্রান্ত হয়ে যাই।

সর্বশেষ খবর