সোমবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

সব হারিয়ে দিশাহারা ওরা

রূপনগরে বস্তি পুড়ে ছাই

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজধানীর রূপনগরের চলন্তিকা বস্তির ক্ষতিগ্রস্ত তিন হাজার পরিবারের অন্তত ১০ হাজার বাসিন্দা এখন চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন। তাদের মধ্যে নারী-শিশুরা রয়েছেন নানান ঝুঁকির মধ্যে। অথচ এ বস্তিকে কেন্দ্র করে ঘরপ্রতি বাড়তি ভাড়া, অবৈধ গ্যাস, বিদ্যুৎ আর মাদক ব্যবসা থেকে প্রতি মাসে কোটি টাকার বাণিজ্য হতো। স্থানীয় রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় প্রভাবশালী ২০ জনের একটি সিন্ডিকেট এই অবৈধ কর্মকা- নিয়ন্ত্রণ করত বলে ক্ষতিগ্রস্ত বেশ কয়েকজন এ তথ্য জানিয়েছেন।

বর্তমানে বস্তির আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখভাল করছে পুলিশ। পুলিশ বলছে, বস্তিকেন্দ্রিক স্থানীয়দের নানান কর্মকা- ছিল। এর মধ্যে মাদক ব্যবসা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। তবে গ্যাস, বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগ দেখার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। মূলত গ্যাস, কেরোসিনসহ দাহ্য পদার্থের কারণেই আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, ১৯৭৫ সাল থেকে এই বস্তিতে লোকজন বসবাস করছে। এটি মূলত একটি ডোবা। পানির ওপর কাঠ, বাঁশ আর টিন দিয়ে মাচার ওপর একতলা ও দোতলা প্রায় দুই হাজার ঘরে ৫০ হাজার লোক বসবাস করছে। এর মধ্যে আগুনে পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় এক হাজার ঘরের মানুষ অনেকটা আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। তাদের থাকা, খাওয়া, গোসল আর প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে প্রতি মুহূর্তে চরম বিপাকের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। এতসব সমস্যার মধ্যেও তাদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। এই অগ্নিকান্ডের পর ফের তারা বস্তিতে থাকতে পারবেন কিনা। কারণ বস্তিতে পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগানো হয়েছে বলে তারা মনে করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বস্তির এক বাসিন্দা বলেছেন, এরই মধ্যে পুলিশের পক্ষ থেকে তাদের বিকল্প চিন্তা করতে বলা হয়েছে। যদিও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র তাদের বলেছেন, বাউনিয়াবাদে সরকারি ভবনে তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তবে বস্তির নিয়ন্ত্রণে থাকা স্থানীয় প্রভাবশালী ২০ জনের একটি সিন্ডিকেট তাদের আশ্বস্ত করে বলেছে, তারা ফের ঘর তুলবে, এরপর তাদের ভাড়া দেওয়া হবে। নতুন ঘরে উঠতে হলে তাদের দিতে হবে বাড়তি টাকা। আগে তারা দিত ঘরপ্রতি দুই থেকে তিন হাজার টাকা। এরপর সেখানে থাকতে হলে তাদের আরও এক হাজার টাকা বেশি দিয়ে থাকতে হবে। এভাবেই চক্রের সদস্যরা বস্তি থেকে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করতে নতুন পরিকল্পনা করেছে বলে গত তিন দিনে সরেজমিন বস্তির লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

বস্তির কয়েকজন বাসিন্দা জানান, বস্তির একটি ঘর নিয়ে থাকতে হলে তাদের মাসে ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৭০০ টাকা শুধু ভাড়াই দিতে হয়। এর পাশাপাশি বিদ্যুৎ বিল বাবদ ৩০০ আর গ্যাস বিল বাবদ ৫০০ টাকা দিতে হতো। বস্তিতে তার মালিকের ২০টি ঘর ছিল। আর এই ২০টি ঘর থেকেই মালিক কম করে হলেও মাসে ১০ হাজার টাকা তুলতেন। সেই সঙ্গে পানির জন্য আরও ১০০ টাকা দিতে হতো। মাস শেষে এসব টাকা দিতে দেরি হলে তাদের নানান বাজে কথা শুনতে হতো। সেই সঙ্গে বস্তি থেকে উচ্ছেদ করার হুমকি দেওয়া হতো। গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির কোনো মিটার নেই।

বস্তির ঝিলপাড় অংশের মালিক ময়না বেগম নামে এক নারী। তিনি বলেন, বস্তিতে ৩০টি ঘরের মধ্যে ২৬টি ঘরের ভাড়া তুলতেন তিনি। চারটিতে স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে তিনি থাকতেন। প্রতি রুমের ভাড়া দুই থেকে তিন হাজার টাকা ছিল। তার বস্তিতে গ্যাস সংযোগ দিতে দুলাল নামে একজন প্রতি মাসে তার কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা আর বিদ্যুৎ বিল বাবদ ৭ হাজার টাকা নিয়ে যেত।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বস্তিতে যত অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ রয়েছে তার সব অংশ থেকে প্রতি মাসে টাকা তুলত সে। বস্তির লোকজনের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ১০ হাজার ঘরে অবৈধ গ্যাস সংযোগ ছিল। তার সব টাকাই দুলাল প্রতি মাসে তুলত। আর এ কারণে বস্তি এলাকায় দুলালকে এক নামে সবাই চেনে। স্থানীয় বস্তি সিন্ডিকেট তাকে এ টাকা ওঠানোর দায়িত্ব দেয়।

এ বিষয়ে দুলালের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বস্তির ঘরের মালিকদের হয়ে তিনি অবৈধ গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগের টাকা তোলেন। এই টাকার ভাগ পায় গ্যাস-বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ। প্রতি মাসে এই অবৈধ টাকার ভাগ গ্যাস-বিদ্যুৎ অফিসের লোকজনের পাশাপাশি স্থানীয় রাজনীতিকদের পকেটেও যেত। দুলালের একটি মোটরসাইকেল আছে। তিনি প্রতি মাসের ১ থেকে ৫ তারিখের মধ্যে বস্তি এলাকায় এসে টাকা তুলতেন।

ক্ষতিগ্রস্ত বস্তির আরামবাগ অংশের সাতটি ঘরের মালিক আলমগীর হোসেন নামে এক ব্যক্তি। তিনি দেড় বছর ধরে বস্তিতে সাতটি ঘর তৈরি করে ভাড়া তুলছেন। তিনি বলেন, বস্তির আরামবাগ অংশেই প্রায় আট হাজার ঘর রয়েছে। এই অংশের গ্যাস-বিদ্যুতের অবৈধ অংশের বিল নিত রহিম নামে একজন। এ ছাড়া আরামবাগ অংশের চারটি ঘরের মালিক জাকির হোসেন নামে অপর একজন। তিনি বলেন, রহিমকে তিনি গ্যাস-বিদ্যুতের টাকা দিতেন। তবে রহিম দাবি করেছেন, তিনি গ্যাস-বিদ্যুতের টাকা তুলে স্থানীয় রাজনীতিকদের পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও গ্যাস অফিসের ঊর্ধ্বতনদের হাতে পৌঁছে দিতেন। এ ছাড়া বস্তির চলন্তিকা অংশের অবৈধ গ্যাস-বিদ্যুতের ভাড়া তুলতেন শামসু মিয়া নামে একজন। শামসু বলেন, চলন্তিকা অংশের সাত হাজার ঘরের মালিক আমজাদ হোসেন নামে একজন।

এদিকে, অগ্নিকান্ডে  ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসী বর্তমানে স্থানীয় স্কুল ও মাঠে অবস্থান করছে। সেখানে অবস্থানকারী মজিবর রহমান নামে একজন বলেন, সিটি করপোরেশন ও স্থানীয় সংসদ সদস্যের পক্ষ থেকে তাদের দুপুর ও রাতে দুই বেলা খাবার দেওয়া হচ্ছে। দুপুরে তাদের সাদা ভাত ও গরুর মাংস খাওয়ানো হয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ১৫ আগস্টের জন্য বরাদ্দ থাকা চারটি গরু বস্তিবাসীর খাবারের জন্য দেওয়া হয়েছে। তিনটি গরু এরই মধ্যে জবাই করে খাওয়ানো হয়েছে।

মজিবর বলেন, এই বস্তিতে তিনি ৩০ বছর ধরে রয়েছেন। এখানেই তার চার সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করেছেন। বস্তিতে এত বড় আগুন আগে কখনো লাগেনি। এর আগে বিএনপি-জামায়াত সরকারে থাকার সময় একবার বস্তিতে উচ্ছেদ অভিযান চালানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তবে বস্তির লোকজনের বাধায় তা রোধ হয়েছিল। এখন ক্ষমতাসীনরাই বস্তির সব কর্মকান্ড দেখভাল করে। এক সময় বস্তিতে মাদকের ব্যাপক প্রভাব ছিল। তবে গত এক বছরে মাদকবিরোধী অভিযানে তা অনেক নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বস্তির আগুনে শত শত পরিবারের স্বপ্ন পুড়ে গেছে।

শুক্রবার সন্ধ্যায় রূপনগরের চলন্তিকা বস্তিতে আগুনের সূত্রপাত। ফায়ার সার্ভিসের ২৪টি ইউনিট তিন ঘণ্টার প্রচেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। অগ্নিকান্ডের এ ঘটনায় চারজন আহত হয়েছেন। ঘটনার সঠিক তথ্য জানতে ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (অ্যাম্বুলেন্স) আবুল হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর