বুধবার, ২১ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা
রূপনগরে বস্তিতে আগুন

পোড়া জায়গাতেই নতুন সংগ্রাম

” আল্লাহ জানে আমাদের কী হবে! আগুন যেদিন লাগছিল সেদিন রাস্তায় ছিলাম। এরপর থেইক্যা এই পোড়া ঘরেই আইস্যা থাকা শুরু করছি।

জিন্নাতুন নূর

পোড়া জায়গাতেই নতুন সংগ্রাম

পুড়ে যাওয়া ঘরের স্থানেই চলছে খাওয়া-দাওয়া। গতকাল রাজধানীর রূপনগরে বস্তি থেকে তোলা ছবি -জয়ীতা রায়

চারদিকে পোড়া কাঠ, টিনসহ ঘরের বিভিন্ন সামগ্রী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কাঞ্চন মল্লিকের পুড়ে যাওয়া বাড়িটির অবকাঠামোর আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। মাথার ওপর কোনোরকমে কাগজ দিয়ে রোদ ঠেকানোর ব্যবস্থা করে মাটিতে কাপড় বিছিয়ে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন কাঞ্চন। গত তিন দশক ধরে স্ত্রী মায়া বেগম ও সন্তানদের নিয়ে তিনি রূপনগরের চলন্তিকা ঝিলপাড় বস্তিতে বাস করছেন। গত ১৬ আগস্টের ভয়াবহ আগুনে মাথা গোঁজার একমাত্র ঠাঁইটি জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও বেদখল হয়ে যাওয়ার ভয়ে এখন পরিবার নিয়ে খোলা আকাশের নিচে পোড়া বাড়ির জায়গাটিতেই আবার  আশ্রয় নিয়েছেন কাঞ্চন। গতকাল দুুপুরের খাবার খাওয়ার সময় উদাস কণ্ঠে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে কাঞ্চন বলেন, ‘আল্লাহ জানে আমাদের কী হবে! আগুন যেদিন লাগছিল সেদিন রাস্তায় ছিলাম। এরপর থেইক্যা এই পোড়া ঘরেই আইস্যা থাকা শুরু করছি। বিদ্যুতের কানেকশন পাইছি কিন্তু পানি বাইরে থেইক্যা আনতাছি।’ সরেজমিন ঘুরে কাঞ্চন মল্লিকের মতো বস্তির আরও বাসিন্দাকেই গতকাল বস্তিটির পুড়ে যাওয়া ঘরগুলোতে শুয়ে-বসে থাকতে দেখা যায়। রহিমা নামের এক নারীকে আসবাবপত্রহীন পুড়ে যাওয়া ঘরের মাটিতেই শুয়ে থাকতে দেখা যায়। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু বিদ্যা নিকেতন স্কুলের পাশ দিয়ে বস্তির প্রবেশপথে যে কয়েকটি আধাপাকা ঘরের অবকাঠামো এখনো মাটির সঙ্গে মিলিয়ে যায়নি সেখানে মানুষজন আবারও নতুন করে বসবাসের চেষ্টা শুরু করছেন। এসব ঘরের বাসিন্দারা নিজেদের পুড়ে যাওয়া আসবাবপত্রগুলোর কালি ঝেড়েমুছে তা আবার ব্যবহার উপযোগী করে তুলছেন। এদেরই একজন মো. জলিল। তিনি পেশায় রিকশাচালক এবং তার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে গত চার দশক ধরে ঝিলপাড় বস্তিতে থাকছেন। জলিলের স্ত্রী তাদের পুড়ে যাওয়া মিটসেফ, টেবিল ফ্যান এবং কিছু কাঁথা দিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলেন। কথা হলে এই দম্পতি জানান, গত চার দশক ধরে এখানে বাস করছেন। ভয়াবহ আগুনে শুধু জীবন বাঁচাতে পেরেছেন। এই সরকারি জমি থেকে কেউ তাদের কখনো উচ্ছেদ করার চেষ্টা করেনি। ভয়াবহ আগুনে তাদের একমাত্র মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু ধ্বংস হয়ে গেলেও শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এই বৃদ্ধ দম্পতি এখানেই জীবন কাটিয়ে দিতে চান। জলিলের মতো এই বস্তির পুরনো ও অন্য বৃদ্ধ বাসিন্দাও তাদের পুড়ে যাওয়া ঘরটির খুঁটি ধরে আছেন। সেখান থেকে তারা সরছেন না। বস্তিতে মুদি দোকান ছিল নাছিমা বেগমের। সেই দোকানেই ছিল তিনি ও তার পরিবারের বসবাস। কিন্তু আগুনে ঘর ও জীবিকা দুই হারিয়ে নাছিমা এখন দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। তিনি বলেন, আল্লাহ ছাড়া আমাদের এখন আর কোনো ভরসা নেই। একই অবস্থা চাল ব্যবসায়ী মো. আলমগীরের। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে আলমগীর বলেন, সমিতি থেকে দেড় লাখ টাকা ঋণ নিয়ে চাল কিনেছিলাম। আগুনে প্রায় অর্ধশতাধিক বস্তা চাল পুড়ে গিয়েছে। ঋণের টাকা শোধ না করে আবার কীভাবে ব্যবসা শুরু করবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। এরই মধ্যে ঘরের পুড়ে যাওয়া টিন ও আসবাবপত্র ভাঙারি দোকানির কাছে যে দাম পাচ্ছেন সে দামেই বিক্রি করছেন বস্তির বাসিন্দারা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বস্তির তিন হাজারের বেশি রুমে প্রায় ২৫ হাজারের মতো মানুষ থাকতেন। গত শুক্রবারের আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য স্থানীয় প্রশাসন সাময়িকভাবে আশপাশের চারটি বিদ্যালয়ে থাকা ও তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। স্থান সংকুলান না হওয়ায় অনেকেই বিদ্যালয়ে থাকার সুযোগ পাননি। কেউ কেউ আশপাশের এলাকায় ঘরভাড়া নিয়েছেন। কিন্তু এই অবস্থাতেও একশ্রেণির মালিক ঘরভাড়া এক থেকে দুই হাজার টাকা বৃদ্ধি করে দিয়েছেন।

 এতে কেউ কেউ রাস্তার ওপরও থাকছেন। বস্তির পাশেই বঙ্গবন্ধু বিদ্যা নিকেতনে গিয়ে দেখা যায়, বস্তির বাসিন্দারা লাইনে দাঁড়িয়ে দুপুরের খাবার সংগ্রহ করছিলেন। পাশেই বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষগুলোতে কাপড় ও কাগজ বিছিয়ে এক-একটি পরিবার কোনোমতে থাকছে। ক্ষতিগ্রস্তরা জানান, খাবারের ব্যবস্থা করলেও নতুন করে ঘরবাড়ি তৈরির জন্য প্রশাসন কোনো অর্থ সহায়তা দিচ্ছে না।

তবে এখন পর্যন্ত এই বস্তি থেকে তাদের উচ্ছেদের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ক্ষতিগ্রস্তদের জানান যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবেন।

সর্বশেষ খবর