বুধবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

ঠেকানো যাচ্ছে না বাল্যবিয়ে

বয়স লুকিয়ে, জন্মসনদ ঘষামাজা করে গোপনে চলছে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের বিয়ে

জিন্নাতুন নূর

ঠেকানো যাচ্ছে না বাল্যবিয়ে

সরকার বাল্যবিয়ে রোধে নানা উদ্যোগ নিলেও বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে ঠেকানো যাচ্ছে না। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে শহরের অভিভাবকরা তাদের কন্যাসন্তানের বয়স লুকিয়ে বাল্যবিয়ে দিচ্ছেন। রাতের আঁধারে গোপনেই সারা হচ্ছে বিয়ের আয়োজন। জন্মসনদে অপ্রাপ্তবয়স্ক কনের বয়স বাড়িয়ে কৌশলে প্রাপ্তবয়স্ক বানিয়ে বিয়ে পড়ানো হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণ আদালত এসব বিয়ে থামালেও গোপনে আয়োজন করায় অনেক ক্ষেত্রেই তা থামানো সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে সারা দেশে বাল্যবিয়ে হয় মোট নয়জনের। আর বাল্যবিয়ের হাত থেকে রক্ষা পায় মোট ৪৮ জন কিশোর-কিশোরী। অইনজীবীরা জানান, বিশেষ প্রেক্ষাপটে কম বয়সী ছেলে-মেয়েদের বিয়ের বিধান রেখে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-২০১৭’ পাস হওয়ায় আগের তুলনায় বাল্যবিয়ে আরও বেড়েছে। এ আইনে সুবিধাভোগী আইনজীবীরা মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বাল্যবিয়ে করাতে সহযোগিতা করছেন। আবার সনদে ঘষামাজা করে আর এফিডেভিটের মাধ্যমে বয়স পরিবর্তন করেও অভিভাবকরা সন্তানদের কম বয়সে বিয়ে দিচ্ছেন। চলতি বছরে চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় দুই  কিশোরীর অভিভাবক এমনটিই করেন। এদের একজনের অভিভাবক সুকৌশলে মেয়েটির ইউনিয়ন পরিষদের জন্মসনদে ঘষামাজা করে মেয়েটির বয়স বাড়াতে ২০০২ সালের বদলে তার জন্মসাল ২০০০ সাল বানিয়ে আকদের আয়োজন করে। আরেক কিশোরীর অভিভাবকরা এফিডেভিট করে মেয়েটির জন্মসাল ২০০২ সালের বদলে ২০০০ সাল করে তার বিয়ের আয়োজন করেন। কিন্তু হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রুহুল আমিন এ বিয়ে বন্ধ করেন। সম্প্রতি সিরাজগঞ্জের সদর উপজেলার একটি গ্রামে বেশ ঘটা করে মাত্র তৃতীয় শ্রেণিতে পড়–য়া এক স্কুলছাত্রীর সঙ্গে ২৫ বছর বয়সী এক যুবকের বিয়ের আয়োজন করে মেয়েটির অভিভাবকরা। কিন্তু প্রশাসনের তৎপরতায় এই স্কুলছাত্রীর বাল্যবিয়েও বন্ধ করা হয়। বাল্যবিয়ে নিয়ে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউনিসেফ গত বছরের মার্চ মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, বাংলাদেশের শতকরা ৫৯ শতাংশ কিশোরীর তাদের ১৮ বছরে পৌঁছানোর আগেই বিয়ে হয়ে যায়। আর ১৫ বছরে পৌঁছানোর আগেই বিয়ে দেওয়া হয় ২২ শতাংশ কিশোরীকে। ‘গার্লস নট ব্রাইড’ নামে আন্তর্জাতিক একটি সংস্থা ২০১৭ সালে প্রকাশিত তথ্যে, রংপুরে গড়ে ১৫ বছর বয়সী কিশোরীদের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর রাজশাহী ও খুলনায় ১৬ বছর বয়সে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, দরিদ্র পরিবারগুলোতে বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে মেয়ের চেহারার আকর্ষণ কমে যাবে আর তখন বিয়েতে মোটা অঙ্কের যৌতুক দিতে হবেÑ এ ধারণা থেকে বাল্যবিয়ে দেওয়া হয়। গ্রামাঞ্চলে বিয়ের আগে মেয়েরা যাতে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে না পড়ে এবং পরিবারের সুনাম বজায় রাখতে মেয়েদের বাল্যবিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার পরিবারগুলো, বিশেষ করে বন্যাপ্রবণ এলাকার পরিবারগুলো তাদের মেয়েদের বাল্যবিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে দরিদ্র পরিবারগুলো সংসারের খরচ বাঁচাতে এবং কন্যাসন্তানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পেরে কম বয়সে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। বাল্যবিয়ে বন্ধে সরকার এরই মধ্যে বেশ কিছু ইউনিয়ন ও জেলাকে বাল্যবিয়েমুক্ত ঘোষণা করেছে। কিন্তু এই এলাকাগুলো পুরোপুরি বাল্যবিয়েমুক্ত কি না সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। যেমন সাতক্ষীরা সদর উপজেলাকে  ‘বাল্যবিবাহমুক্ত’ ঘোষণা করা হলেও সেখানে থেমে নেই বাল্যবিয়ে। গত বছর বিভিন্ন সময় জেলা বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কমিটির সহায়তায় প্রশাসন অনেকগুলো বাল্যবিয়ের আয়োজন বন্ধ করে। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সাবেক নির্বাহী অ্যাডভোকেট সালমা আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাল্যবিয়ে প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সরকারকে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করতে হবে। এ ছাড়া এ কাজে যারা সহযোগিতা করেন, বিশেষ করে চেয়ানম্যান, মৌলভি, কাজি তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ারও দাবি জানান তিনি।

সর্বশেষ খবর