বুধবার, ২৮ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

রাতের আতঙ্ক গাড়িপার্টি

মির্জা মেহেদী তমাল

রাতের আতঙ্ক গাড়িপার্টি

কয়েক দিন আগের ঘটনা। রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার মাসুদ হোসেন এক রাতে ১৫ নম্বর বাসস্ট্যান্ডের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন গাড়ির অপেক্ষায়। রাত ৮টার দিকে তিন যাত্রী নিয়ে একটি সাদা রঙের মাইক্রোবাস থেকে একজন মতিঝিল যাবে বলে ডাকছিলেন। মাসুদ চালকের সঙ্গে ভাড়ার ব্যাপারে কথা বলেন। মাত্র ৩০ টাকা ভাড়ায় রাজি হন চালক। গাড়িতে ওঠার পরই তিন যাত্রী জিম্মি করেন তাকে। একজন পকেট থেকে ধারালো অস্ত্র বের করে বলেন, ‘কথা বললেই গলা কেটে দেব।’

মানিব্যাগ আর মোবাইল ফোন নিয়ে পল্টন এলাকায় মাসুদকে নামিয়ে দিতে চান তারা। বিপত্তি বাধায় মানিব্যাগে থাকা একটি ক্রেডিট কার্ড। যানজটের মধ্যে গাড়ি ধীরে চলতে থাকে, আর ভিতরে জেরা! মাসুদের কার্ডের পিন নম্বর চান তারা। তিনি ভুলে গেছেন বলে দাবি করলে ধারালো ছোরা গলায় চেপে ধরে। পেছন থেকে আরেকজন রড দিয়ে আঘাত করেন। এক পর্যায়ে পিন নম্বর বলে দেন মাসুদ। মতিঝিলে একটি ব্যাংকের এটিএম বুথের কাছে গিয়ে মাইক্রোটি দাঁড়ায়। একজন নেমে যান। গাড়ি আবার চলতে থাকে। কিছুক্ষণ পর একটি কল আসে একজনের ফোনে। তখন গাড়ি ঘুরে আবার দৈনিক বাংলা  মোড়ে আসে। হঠাৎ করেই গাড়ির দরজা খুলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয় মাসুদকে। ভুক্তভোগী মাসুদ জানান, নগদ আট হাজার ও ক্রেডিট কার্ডের ২৮ হাজার টাকা খোয়ান তিনি। এফডিসির সামনে একই রকম ঘটনার শিকার হন বনশ্রীর আশরাফ হোসেন। প্রাইভেট কারে চড়েছিলেন আশরাফ। গাড়ির ভিতর যাত্রীরা তার কাছ থেকে টাকা-পয়সা লুটে নিয়েছে।

রাজধানীতে এখন আতঙ্ক ‘গাড়িপার্টি’। দিনে-রাতে নগরজুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বেপরোয়া এ চক্র। বলতে গেলে ‘অভিজাত ছিনতাই চক্র’। প্রাইভেট গাড়িতে ভাড়ায় যাত্রী নেওয়ার কথা বলে তারা সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে। যাত্রীর ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড দিয়ে টাকা তুলে নিচ্ছে এটিএম বুথ থেকে। এখানেই থেমে থাকে না এ চক্র। কারও কাছে টাকা বা মূল্যবান কিছু না পেলে তাকে আটকে আদায় করছে মুক্তিপণ। ইতিমধ্যে এমন বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটে গেছে। যাত্রী পরিবহনের নামে টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় ওরা। এ জন্য তারা বেছে নেয় অফিসে যাওয়ার বা ফেরার সময়কে। এ সময় ওতপেতে থাকে নির্ধারিত স্থানে। কাক্সিক্ষত কাউকে দেখলেই যাত্রীর জন্য ডাকাডাকি শুরু করে। গাড়ি দিয়ে ছিনতাই করাই তাদের কাজ। কিন্তু ঝামেলা এড়াতে থানা-পুলিশের সহায়তা চাচ্ছেন না ঘটনার শিকার অনেকেই। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দাবি করেছে, কয়েক বছর আগের তুলনায় এ ধরনের ঘটনা অনেক কমেছে। কিন্তু এমন ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই এরা ছিনতাইকারী। আবার কখনো ফাঁকা রাস্তায় জোর করেই গাড়ির মধ্যে টেনে নেয়। গাড়িতে তুলেই শুরু হয় নির্মম নির্যাতন। টাকা, মানিব্যাগ, মোবাইল, ব্যাংকের ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড সবই তাদের চাই। মোটরসাইকেল আরোহীদেরও রেহাই নেই তাদের কবলে পড়লে। মোটরসাইকেলের চাবি কেড়ে নেওয়ার পাশাপাশি সবই লুটে নেয় প্রতারক চক্র। রাজধানীতে সক্রিয় হয়ে ওঠা এমন চক্রকে ‘গাড়িপার্টি’ বলে অভিহিত করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, গাড়িতে তুলে ছিনতাই করা এমন অন্তত ১০টি চক্র বিমানবন্দর সড়ক, ধানমন্ডি, উত্তরা, আবদুল্লাহপুর, টঙ্গী, বিশ্বরোড, কাওলা, বনানী, মহাখালী, গুলশান, সায়েদাবাদ, গাবতলী, কমলাপুর ও মতিঝিলসহ অভিজাত এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এলাকাভিত্তিক অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ঘটনায় প্রতারণার শিকার ব্যক্তিরা প্রশাসনের দ্বারস্থ হন না। কখনো কখনো থানায় অভিযোগ করলেও প্রতিকার মেলে না। গাড়িপার্টির শিকার বাবুল বলেন, কী আর হবে। পুলিশকে জানিয়ে প্রতিকার পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, শেরেবাংলা নগর এলাকার তালতলা বাস স্টপেজ থেকে ফার্মগেট আসার পথে গাড়িপার্টির শিকার হন তিনি। তিনি জানান, সময় তখন সকাল সোয়া ৯টা। গণপরিবহনে ওঠার মতো অবস্থা নেই। প্রতিটি বাস যাত্রীতে পরিপূর্ণ। এ সময় তালতলায় একটি প্রাইভেটকার থামানো ছিল। ফার্মগেট ফার্মগেট বলে ডাকছিল চালক। তিনি কারে ওঠেন। তিনি জানান, এর আগেও কয়েকবার এভাবে তালতলা থেকে ফার্মগেটে গেছেন। কোনো সমস্যা হয়নি। চালকের পাশে আগে থেকেই একজন বসা ছিল। তার সঙ্গে ওঠে আরও দুজন। তারা বাবুলের দুই পাশের সিটে বসে। গাড়িটি আইডিবি ভবনের সামনে যাওয়া মাত্রই দুই পাশের দুই ব্যক্তি গাড়ির গ্লাস বন্ধ করে দেয়। বাবুল তখন গ্লাস বন্ধ না করতে বললে তাদের একজন বলে, ঠা-া বাতাস আসছে। জানালা বন্ধ করেই শুরু হয় তাদের ভয়ঙ্কর মিশন। দুই পাশের দুই যুবক তার দিকে অস্ত্র তাক করে। একজনের হাতে পিস্তল। অন্যজনের হাতে ধারালো ছুরি। চালকের আসনের পাশে বসা যুবকটি বলে, কী কী আছে দিয়ে দেন। ডেবিট কার্ড ও পিন নম্বর দেন। চালাকি করলে জানে মেরে ফেলব। বাবুলের কাছে কোনো কার্ড ছিল না। নগদ টাকা ছিল ১৮ হাজার। সেই টাকা তাদের হাতে তুলে দিলেন। বাবুলকে মহাখালী নামিয়ে দিয়ে তারা চলে যায়। যথারীতি তারা আগে হুমকি দিয়ে যায় বিষয়টি কাউকে জানালে পরিণতি হবে ভয়াবহ।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর