শনিবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৯ ০০:০০ টা

ডাকাতিতে সাজা হয় মাত্র ২৩ শতাংশ মামলায়

মাহবুব মমতাজী

ডাকাতিতে সাজা হয় মাত্র ২৩ শতাংশ মামলায়

ডাকাতির ঘটনায় মাত্র ২৩ শতাংশ মামলায় আসামির সাজা হয়। খালাস পেয়ে যান ৭৭ শতাংশ মামলাতেই। এর মধ্যে বৈরী সাক্ষীর কারণে খালাস হয় ৬৫.৫ শতাংশ, তদন্তের ভুলের কারণে ২৮.৮ শতাংশ, ম্যাজিস্ট্রেটের ভুলের কারণে ২.১ শতাংশ মামলার আসামিরা খালাস পান। আর বাদী, সাক্ষী, প্রসিকিউশন সক্রিয় থাকার পরও খালাস হয় ৩.৬ শতাংশ মামলার আসামির। চলতি বছরের গত জুনে পুলিশের তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) এক গবেষণায় এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

২০১৬ সালে ২১টি জেলায় হওয়া ১২৬টি ডাকাতি মামলার রায় এবং ২০১৭ সালে ২৫টি জেলায় হওয়া ১২১ মামলার রায় পর্যালোচনা করে তথ্যগুলো তুলে ধরেছে সংস্থাটি। এই মামলাগুলো হয়েছে ১৯৮৭ সাল থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে। মোট ২৪৭টি মামলার মধ্যে ১৬৩টি ছিল গৃহ ডাকাতির। ৪৭টি ছিল সড়ক ডাকাতির এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ডাকাতির মামলা ছিল ১৪টি। অন্যান্য ডাকাতির ঘটনায় মামলা হয় ২৩টি। এসব মামলায় মোট এক হাজার ৯৩২ জন আসামির বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় পুলিশ। এর মধ্যে ৫৬টি মামলায় সাজা হয়েছে ২২৭ জনের। এর মধ্যে সর্বোচ্চ সাজা হয়েছে ৩৪ জনের। দুটিতে মৃত্যুদ- হয়েছে ১৮ জনের। চারটিতে ১৬ জনের যাবজ্জীবন হয়েছে। আর বাকি ১৯৩ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। ১৯১টি মামলায় মোট এক হাজার ৭০৫ জন খালাস পেয়েছে। পিবিআই প্রধান পুলিশের ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার এ প্রতিবেদককে বলেন, ডাকাতির মামলাগুলোতে পুলিশ এত কষ্ট করে চার্জশিট দেয়, তবুও আসামিরা খালাস পেয়ে যায়। এসবের কারণ খুঁজতেই মূলত আমরা গবেষণাটি করেছিলাম। এর পাশাপাশি ডাকাতদের শেষ পরিণতি কী দাঁড়াচ্ছে তা জানাটাও ছিল অন্যতম কারণ। কিন্তু গবেষণায় ডাকাতি মামলার রায়গুলো পর্যালোচনায় আসামিরা খালাস পেয়ে যাওয়ার পেছনে পুলিশের তদন্তে গাফিলতি, বৈরী সাক্ষী এবং বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার বিষয়গুলো উঠে এসেছে।

খালাস পাওয়ার কারণ : আদালতে সাক্ষীদের অনুপস্থিতি, আসামিকে চিনতে না পারা, সাক্ষীরা সঠিকভাবে সাক্ষ্য না দেওয়া, জব্দ তালিকা তৈরিতে ভুল, শনাক্তকরণ (আদালতে নেওয়ার আগে সাক্ষীকে আসামি দেখানো) মহড়ায় ভুল, এজাহারে ভুল, পিসিপিআর (অতীত রেকর্ড) যাচাই না করা, সাক্ষ্য-প্রমাণ সঠিকভাবে উপস্থাপন না করা, সাক্ষীদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য, ১৬৪ ধারায় আসামির জবানবন্দি সঠিকভাবে রেকর্ড না হওয়া। খালাস পাওয়া ১৯১টি মামলার মধ্যে বৈরী সাক্ষীর কারণে খালাস পেয়েছে ১২৫টিতে, তদন্তের ভুলের কারণে ৫৫টিতে, ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি সঠিকভাবে না নেওয়ার কারণে ৪টিতে এবং বাদী, সাক্ষী, প্রসিকিউশন সক্রিয় থাকার পরও খালাস হয়েছে ৭টিতে। পিবিআইর তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে রায় হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে যেসব মামলায় সাজা হয়েছে তার চাইতে খালাস পাওয়া মামলাগুলোর তদন্তে সময় লেগেছে বেশি। খালাস পাওয়া মামলাগুলোতে পুলিশের তদন্তকাজে গড় সময় লেগেছে এক বছর ৪ মাস এবং আদালতে বিচারকাজে গড় সময় লেগেছে ১১ বছর ৬ মাস। সাজাপ্রাপ্ত মামলাগুলোতে পুলিশের তদন্তকাজে গড় সময় লেগেছে এক বছর দুই মাস এবং আদালতে বিচারকাজে গড় সময় লেগেছে ১০ বছর তিন মাস। সব ডাকাতির মামলাতে পুলিশের তদন্তে সর্বনিম্ন সময় লেগেছে প্রায় দুই মাস। সর্বোচ্চ সময় লেগেছে ১১ বছর। আদালতে সর্বনিম্ন সময় লেগেছে ৭ মাস এবং সর্বোচ্চ সময় লেগেছে ২৭ বছর ৯ মাস। মামলা হওয়ার দিন থেকে রায়ের দিন পর্যন্ত দ্রুততম সময়ে নিষ্পত্তি হওয়া একটিতে সময় লেগেছে দুই বছর। আর দীর্ঘ সময় নিষ্পত্তির মধ্যে লেগেছে ২৯ বছর।

সর্বোচ্চ সাজার মামলা : ২০০৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালীর সুধারাম থানায় একটি ডাকাতি মামলা হয়। ২০১৬ সালে এ মামলার রায়ে ১২ জনের মৃত্যুদ  হয়। তদন্ত ও বিচারকাজে মামলা নিষ্পত্তি হতে সময় লাগে প্রায় ৯ বছর দুই মাস। এ মামলা হওয়ার আগের দিন নোয়াখালীর মাইজদীতে মোবাইল ফেয়ার নামে দোকানের মালিক, তার ভাই ও কর্মচারীসহ রিকশায় করে বাসায় ফিরছিলেন। ফেরার সময় পথরোধ করে পুলিশ পরিচয়ে তাদের মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়া হয়। এ সময় আগ্নেয়াস্ত্র ও ছুরিকাঘাত করে দুজনকে খুন এবং একজনকে আহত করে ১০ লাখ টাকার মালামাল নিয়ে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।

 ২০১১ সালের ৩০ জুন বাগেরহাট থানায় একটি ডাকাতির মামলা হয়। এ মামলায় তদন্ত ও বিচারে সময় লাগে ৫ বছর ৩ মাস। রায়ে একজনের মৃত্যুদণ্ড ও বাকিদের যাবজ্জীবন সাজা হয়। ২০১৫ সালের ২ মার্চ রাজধানীর রামপুরা থানায় একটি ডাকাতির মামলা হয়, এ মামলার তদন্ত ও বিচারে সময় লাগে দুই বছর। ২০১৭ সালে এ মামলার রায়ে ৫ জনকে মৃত্যুদ , দুজনকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদ  এবং বাকি দুজনকে দুই বছর করে সশ্রম কারাদন্ড  দেওয়া হয়। ২০০৭ সালের ৮ অক্টোবর নরসিংদীর শিবপুর থানায় মাইক্রোবাস ডাকাতির একটি মামলা হয়। এর তদন্ত ও বিচারে ১০ বছর ও ১০ মাস সময় লাগে। মামলার রায়ে ৮ আসামির সবাইকে যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয়। ২০১২ সালের ৯ নভেম্বর গাজীপুরের শ্রীপুর থানায় একটি ডাকাতির মামলা হয়। এর তদন্ত ও বিচারের সময় লাগে ৪ বছর ৯ মাস। রায়ে ৯ আসামির মধ্যে একজনকে যাবজ্জীবন এবং বাকিদের খালাস দেওয়া হয়। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার একটি ডাকাতি মামলার রায়ে সাত আসামির মধ্যে ৩ জনের যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদ  এবং বাকিদের খালাস দেওয়া হয়। এ মামলার তদন্ত ও বিচারে সময় লাগে ৪ বছর ৪ মাস।

সর্বশেষ খবর