সোমবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা
অষ্টম কলাম

ফ্রি ভিসা যেভাবে কন্ট্রাক্ট ভিসা

সৌদি আরবে প্রতারণার ফাঁদ

মোস্তফা কাজল, সৌদি আরব থেকে ফিরে

সৌদি আরবে কর্মসংস্থানের নামে প্রতারণার নিত্যনতুন কৌশলে ধরাশায়ী হয়েছেন সেখানে যাওয়া বহু বাংলাদেশি শ্রমিক। বিশেষ করে সেখানে চলছে ফ্রি ভিসার নামে কন্ট্রাক্ট ভিসার কারবার। এতে বেড়েছে প্রবাসী শ্রমিকদের আহাজারি ও বুকফাটা আর্তনাদ।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবের বিভিন্ন স্থান সরেজমিন ঘুরে পাওয়া গেছে একাধিক প্রতারণা চক্রের নানা তথ্য। জানা গেছে, সুখের আশায় শ্রমিকদের প্রায় সবাই সহায়-সম্বল বিক্রি করে, কিংবা সুদের পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা খরচ করে বৈধ কন্ট্রাক্ট ভিসা, বিএমইটি ছাড়পত্র, কাজের চুক্তিপত্র (আকামা) নিয়ে সৌদি আরব গেছেন। কিন্তু তাদের অনেকেই দীর্ঘ সাত মাসে চার কোম্পানিতে কাজ করে বেতন-ভাতা না পেয়ে এখন বিভিন্ন মার্কেট ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ড কার পার্কিংয়ে রাত কাটিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, চলতি বছরের মার্চ মাসে যাত্রার শুরুতেই প্রতারণার খপ্পরে পড়েন দেড় শতাধিক শ্রমিক। তাদের অনেকেই জানান, দালালরা তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে সৌদি আরবের ফাহাদ  কোম্পানিতে রোড ক্লিনারের ভিসার কথা বলে। কিন্তু ভিসা স্ট্যাম্পিং হওয়ার পর শ্রমিকরা দেখতে পান ফাহাদ কোম্পানির স্থলে বাবতেইন কোম্পানির ভিসা লেগেছে। তখন তারা এই ভিসায় সৌদি আরব  যেতে অস্বীকৃতি জানান। কিন্তু দালালরা শ্রমিকদের জানান, ‘এগুলো কন্ট্রাক্ট ভিসা। বাবতেইন কোম্পানির ভিসা হলেও কাজ ফাহাদ কোম্পানিতে করতে হবে।’ তাই তারা চিন্তা না করে সৌদি আরব গিয়ে কাজে যোগদানের কথা জানান। পরে কাজে যোগদানের পরই দেড় শতাধিক লোক জানতে পারেন তারা সবাই প্রতারিত হয়েছেন। জানা গেছে, এভাবে জনশক্তি রপ্তানির সব নিয়মনীতি মেনে দালালরা কৌশলে হাজার হাজার ফ্রি ভিসা কন্ট্রাক্ট ভিসা বলে চালিয়ে দিলেও প্রবাসীদের কল্যাণে নিয়োজিত সংস্থাগুলোর কিছুই নজরে আসছে না। প্রতিনিয়ত হাজার হাজার শ্রমিক প্রতারণার শিকার হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে দেশে ফিরলেও টনক নড়ছে না কর্তাব্যক্তিদের। প্রতারণা বন্ধেও  নেওয়া হচ্ছে না প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।

ভুক্তভোগী একজন হোসেন মিয়া মাতবর অভিযোগ করে জানান, তিনি বিগত জুন মাসে ফ্রি ভিসায় সৌদিতে গেছেন। এক মাস পর জানতে পারেন, তিনি কন্ট্রাক্ট ভিসায় গেছেন। এ ভিসায় বেতন কম। দুই মাস পর তার চাকরি চলে যায়।

অভিযোগ থেকে জানা গেছে, প্রবাসী শ্রমিকের রক্তচোষা দালাল চক্র দেশে এবং প্রবাসে গড়ে তুলেছে বিশাল সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট তিন ভাগে ভাগ হয়ে কাজ করছে বলে জানান সৌদি আরবে প্রতারিত কয়েকজন ভুক্তভোগী শ্রমিক। এর একটি অংশ বাংলাদেশে ভিসা বিক্রির কাজে নিয়োজিত। আরেকটি অংশ সৌদি আরব থেকে ভিসা সংগ্রহ এবং অন্যটি সৌদিতে কাজের সন্ধানে থাকে। কেউ সাড়ে চার লাখ, কেউবা পাঁচ লাখ টাকা জমা দিয়ে এদের খপ্পরে আটকা পড়েন। তারা জানান, তখন বাধ্য হয়ে ৯০০ সৌদি রিয়াল বেতনে সৌদি আরবের রিয়াদের উদ্দেশে গেল নভেম্বর মাসে তারা যাত্রা করেন। রিয়াদের বিমানবন্দরে অবতরণের পর তাদের কর্মস্থলে নিয়ে যাওয়ার মতো কাউকে পাওয়া যায়নি। পরে তারা দেশে দালালদের সঙ্গে  যোগাযোগ করলে দুজন বাংলাদেশি যথাক্রমে বাসার ও হাসান তাদের বিমানবন্দর থেকে নিয়ে দাখেল মওদুদ এলাকার একটি বিল্ডিংয়ে রাখেন। তারপর ওখান থেকে কখনো কনস্ট্রাকশনের কাজ, কখনো পাইপ লাইনের কাজ, কখনো ক্লিনারের কাজ করিয়ে কোনো বেতন ভাতা না দিয়ে তাদের  সঙ্গে প্রতারণা করেন। ১২/১৩ ঘণ্টা কাজ করে  বেতন না পেয়ে হতাশ হয়ে অনেকেই এখন দেশে ফিরতে চান।  কয়েকজন ভুক্তভোগী জানান, সর্বশেষ আল কাসিম শহরের পাঁচ নম্বরে একটি ক্লিনার কোম্পানিতে তাদের কাজ দেওয়া হয়। সেখানে ৬০০ রিয়াল  বেতন থেকে ফোরম্যান এবং সুপারভাইজার ৩০০ রিয়াল কেটে রাখেন। টাকা না দিলে তারা মারপিট করেন। ওই ক্যাম্পে একজন বাংলাদেশিকে অতিরিক্ত মারপিট করার ফলে তিনি এখন পাগল হয়ে গেছেন। যে কোনো সময় তিনি মারা যেতে পারেন। সেখানে কোনো চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। এর আগেও দুজন শ্রমিক এভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন। সৌদি আরব প্রবাসী ও জনশক্তি ব্যবসায়ী আবদুল কাদের মিয়ার কাছে ফ্রি ভিসা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ফ্রি ভিসা বলে কোনো ভিসা হয় না। লোকের দেওয়া নাম এটা।’ তিনি কাজ সম্পর্কে জানান, পুরোটাই নসিবের ওপর কাজ। ভাষা জানা থাকলে তারা লাখ টাকা আয় করছে। আবার কেউ নিজের থাকা-খাওয়ার টাকা জোগাড় করতে পারলেও দেশে পরিবারের খরচ ঠিকমতো বহন করতে পারেন না। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, রান্নাঘরে কিংবা এক কক্ষে ৪০/৫০ জনকে থাকতে হয়। তিনি জানান, কোম্পানি থেকে তাদের বের করে দিলে এখানে এসে আশ্রয় নেন। এখন তারা অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছেন। দেশে তাদের স্ত্রী-সন্তান, পরিবার-পরিজন পথের ভিখারি। শুধু তাই নয়, দেশ থেকে পাঠানো শ্রমিকের চুক্তিপত্রের সঙ্গে কাজের কোনো মিল থাকছে না। আবাসিক হোটেলে কাজের কথা বলে সুপার মার্কেটের ক্লিনার কিংবা ট্রলি বয়ের কাজ, পেট্রল পাম্পে কাজের কথা বলে কনস্ট্রাকশনের কাজ করিয়ে মাসের পর মাস বেতন না দিয়ে প্রতারণা করে যাচ্ছে প্রতারক চক্র। প্রকৃতপক্ষে অসহায় শ্রমিকরা ভিসা সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে।

সর্বশেষ খবর