বৃহস্পতিবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

পুলিশের অপরাধ ঠেকাতে জিরো টলারেন্স

এক বছরে ১৩৬৫৫ জনকে লঘুদন্ড, ৬০৪ জনকে গুরুদন্ড৬৯ জন চাকরিচ্যুত, ৫ জনকে বাধ্যতামূলক অবসর

সাখাওয়াত কাওসার

পুলিশের অপরাধ ঠেকাতে জিরো টলারেন্স

ঘটনা-১ : চার-চারবার গুরুতর অপরাধ করেও বহাল তবিয়তে ছিলেন ঢাকা রেঞ্জ অফিসের পুলিশ পরিদর্শক মীর আবুল কালাম আজাদ (৫৪)। ২০১১ সালের ৩ আগস্ট উপ-পরিদর্শক (এসআই) হিসেবে ঢাকা রেঞ্জ অফিসে বদলি হয়ে আসার পর ২০১৫ সালে পদোন্নতি পেয়ে বিশেষ শাখায় (এসবি) বদলি হন। তবে তদবির করে ওই আদেশ ঠেকিয়ে দেন। রয়ে যান ঢাকা রেঞ্জেই। সর্বশেষ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৩৫ লাখ টাকার চেক জালিয়াতি করে ধরা খেয়ে আবুল কালাম এবং তার অন্যতম সহযোগী সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মোস্তাফিজুর রহমান (৩৮) এখন কারাগারে। মোস্তাফিজুর রহমান ২০১৬ সালের ২১ জুন কনস্টেবল থেকে এএসআই পদে পদোন্নতি পেয়ে ঢাকা রেঞ্জে কর্মরত। ২০০৭ সালের ২৬ নভেম্বর কনস্টেবল হিসেবে নিয়োগ পাওয়া মোস্তাফিজ পদোন্নতির আগেও দীর্ঘদিন রেঞ্জ অফিসে কর্মরত ছিলেন। ঢাকা রেঞ্জের একজন অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি এই দুই পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অপরাধের প্রাথমিক সত্যতা পায়। এর পরই এ ঘটনায় মামলা হয়। এ ব্যাপারে ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অর্থ ও প্রশাসন) সালেহ মোহাম্মদ তানভীর বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের ধারণা, তারা হয়তো আগেও এ ধরনের কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ঢাকা রেঞ্জে আসার আগেই মীর আবুল কালাম আজাদ চারবার গুরুদন্ড পান। তবে যেহেতু এ ঘটনায় মামলা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে তদন্ত কর্মকর্তাই এ বিষয়টি নিয়ে বলতে পারবেন।’

ঘটনা-২ : ২০০৯ সালের এক মাদক মামলায় আসামির নাম ও বাবার নামের সঙ্গে মিল থাকায় শ্যামলী লিঙ্ক রোড থেকে মো. কামাল হোসেন নামের এক মোটরসাইকেল মেকানিককে ধরে নিয়ে যান মোহাম্মদপুর থানার এএসআই জাকারিয়া। রাত ৮টা পর্যন্ত দফায় দফায় যাচাই-বাছাইয়ের পর ওই মেকানিককে মুচলেকায় ছেড়ে দেন থানার  ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গণেশ গোপাল বিশ্বাস। তবে পরদিন আবারও ওয়ারেন্টের দোহাই দিয়ে তার দোকানে যান এএসআই আলমগীর। ওই মেকানিককে আরেক ‘জাহালম’ বানানোর বিষয়টি জানতে পারেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। পরে ওই দুই এএসআইকে ক্লোজ করার বিষয়টি জানান তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) ওয়াহেদুল ইসলাম।

ঘটনা-৩ : শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং কুমিল্লা জেলার সাবেক জেলা প্রশাসক এ কে এম শামসুল হক খানের নামের দেওয়া অর্পিত সম্পত্তি দখলের অভিযোগে সহায়তা এবং আর্থিক সংশ্লেষের অভিযোগের সত্যতা পেয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ওয়ারীর উপকমিশনার মোহাম্মদ ইব্রাহীম খানকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ২৬ আগস্ট স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দিন স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে তাকে বরখাস্ত করা হয়।

এর আগে ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন যুগ্ম-কমিশনারের নেতৃত্বে চার সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে আসে, ৮ থেকে ১০ কোটি টাকা উৎকোচ নিয়ে ইব্রাহীমের নেতৃত্বে বর্তমান কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), সাবেক বংশাল থানার ওসি সাহিদুর রহমান এবং সাবেক নবাবপুর ফাঁড়ির ইনচার্জ উপপরিদর্শক (এসআই) জাহাঙ্গীর হোসেন ওই অপরাধে সহায়তা করেছিলেন।

এ তো গেল মাত্র কয়েকটি ঘটনা। গতকাল বিকালেও রাজধানীর মতিঝিল মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সামনে ছিনতাইকারী সন্দেহে বংশাল থানার কনস্টেবল মামুনকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে দিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। অভিযোগ উঠেছে, আবুল কালাম নামে এক ইলেকট্রিক ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে ১০ লাখ টাকা তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় মামুন এবং জিটু নামের আরেকজন ওই ব্যবসায়ীকে জোরপূর্বক মোটরসাইকেলে ওঠাচ্ছিলেন। তবে কালামের চিৎকারে স্থানীয় বাসিন্দারা এগিয়ে আসেন।

পুলিশ সদস্যদের অপরাধ ঠেকাতে কঠোর হচ্ছে পুলিশ সদর দফতর। পুলিশের অপরাধ প্রবণতা কমিয়ে আনতে পুলিশ সুপারদের দেওয়া হয়েছে বিশেষ নির্দেশনা। নীতিনির্ধারকদের বিশেষ সভায় উঠছে এ বিষয়টি। অন্যদিকে ডিএমপির ৫০ থানায় চলছে গোপন নজরদারি। যেসব থানার পুলিশ সদস্যের অতীত রেকর্ড ভালো নয়, সেসব থানায় বেশি নজরদারি চালানো হচ্ছে। যেসব এলাকায় পুলিশের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেশি, এর ভিত্তিতে তৈরি হচ্ছে তালিকা।

পুলিশ সদর দফতর সূত্র বলছে, ২০১৮ সালে ১৩ হাজার ৬৫৫ জনকে লঘুদন্ড, ৬০৪ জনকে গুরুদন্ড, ৬৯ জন চাকরিচ্যুত এবং ৫ জনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। এর আগে ২০১৫ সালে ১০ হাজার ৩৪ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে ৭৮ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। ওই বছর প্রায় ৩০ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়ে। ২০১৬ সালে ১১ হাজার জনের বিভিন্ন ধরনের সাজা হলেও ফৌজদারি আইনে তেমন মামলা হয়নি। ২০১৭ সালে এক হাজার ৫১২ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দিনের পর দিন একই কর্মস্থলে রাখা হলে সেই সব পুলিশ সদস্যদের অপরাধ প্রবণতা বাড়ার আশঙ্কা থাকে। নিয়মতান্ত্রিকভাবে পদোন্নতি ও বদলির বিষয়টি ছাড়াও পুলিশ সদস্যদের কর্মকান্ড নজরদারির মধ্যে রাখা হলে পুলিশের অপরাধের হার কমবে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে বিকল্প তৈরির আগ পর্যন্ত কিছু সময়ের জন্য বিশেষায়িত ইউনিট কিংবা বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের এ নিয়মের বাইরে রাখা উচিত হবে।

পুলিশ সদর দফতরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (এইচআরএম) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বাহিনীর কেউ অপরাধ করলে তার ছাড় নেই। এ ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছে পুলিশ সদর দফতর। কারও অপরাধের দায় বাহিনী নেবে না।

জানা গেছে, পাওনা টাকা আদায় কিংবা কারও পক্ষে জমি-ফ্ল্যাট দখল বা বেদখলে কোনো পুলিশ সদস্য জড়ালে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এগুলো দেওয়ানি আদালতের বিচার্য বিষয় উল্লেখ করে সম্প্রতি ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া স্বাক্ষরিত এক সার্কুলারে মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। ওই সার্কুলারে বলা হয়েছে, অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে ডিএমপির কিছু সদস্য দেওয়ানি আদালতের বিচার্য বিবাদীয় পক্ষের অর্থ আদায়, জমি, প্লট, ফ্ল্যাট কিংবা বাড়ির দখল বুঝিয়ে দেওয়া বা উচ্ছেদ করার বিষয়ে নিজেদের জড়াচ্ছেন।

এরূপ কর্মকান্ডে পুলিশ সদস্যদের জড়িত না হওয়ার জন্য অফিস আদেশের মাধ্যমে ডিএমপিতে কর্মরত সব পুলিশ সদস্যকে নির্দেশ দেওয়া হলো। সার্কুলারে আরও বলা হয়, সংশ্লিষ্ট ডিসি, এডিসি ও এসিরা নিজ অধিক্ষেত্রে (ইউনিট) কর্মরত কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্যরা যাতে এ ধরনের কর্মকান্ডে জড়িত না হন, সে বিষয়টি নিবিড়ভাবে তদারকির মাধ্যমে নিশ্চিত করবেন। পাশাপাশি যদি কোনো পুলিশ সদস্যকে কোনো ব্যক্তি বা মহল এ ধরনের কর্মকান্ডে নিয়োজিত হওয়ার নির্দেশ দেন বা চাপ প্রয়োগ করেন, তা সরাসরি ডিএমপি কমিশনারকে বা নিজ নিজ ইউনিটের প্রধানকে অবহিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএমপির একজন পদস্থ কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, নজরদারির পাশাপাশি ডিএমপির একই স্থানে তিন বছরের অধিক সময় ধরে কর্মরত পুলিশ সদস্যদের শিগগিরই তালিকা করা হবে। কাজে গতিশীলতা আনতে এবং প্রকৃত জনসেবা নিশ্চিত করতেই এ তালিকা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর