শুক্রবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে কিশোর গ্যাং

মাহবুব মমতাজী

দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে কিশোর গ্যাং

‘গ্যাং কালচার’-এর নামে দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার কিশোররা। স্কুল-কলেজপড়ুয়া এসব কিশোর জড়িয়ে পড়ছে খুন, ছিনতাই, মাদক, অপহরণ ও চাঁদাবাজির মতো অপরাধে। ২০১৭ সালে উত্তরায় দুই গ্রুপের বিরোধের জেরে স্কুলছাত্র আদনান নিহত হওয়ার পর ‘গ্যাং কালচার’ আলোচনায় আসে। জানা যায়, রাজধানীতে গড়ে উঠেছে ৩০ থেকে ৩২টি কিশোর গ্যাং। দেয়ালে নিজেদের কোড লিখে এলাকাও ভাগ করে নিয়েছে তারা। তুচ্ছ ঘটনায় প্রায়ই তাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সর্বশেষ বুধবার রাতে কিশোর গ্যাংয়ের দুই গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মোহাম্মদপুর চান মিয়া হাউজিং সোসাইটিতে খুন হয় স্কুলছাত্র মহসিন। রাতেই কেরানীগঞ্জে অভিযান চালিয়ে ঘটনায় জড়িত দুজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

কিশোর গ্যাং সদস্যদের কারও বয়স ১৮-এর বেশি নয়। কেউ পড়াশোনা করে, কেউ করে না। বেপরোয়া স্বভাব, চলাফেরায় থাকে তারা উগ্র। গ্যাং কালচারে জড়িত থাকার অভিযোগে এ বছর অন্তত ৯০ জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে নিজেদের কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কেবল শাস্তি দিয়ে এর সমাধান করা যাবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বখাটেদের গ্যাং গ্রুপগুলো বেশি সক্রিয় উত্তরা, মিরপুর, দক্ষিণখান, খিলক্ষেত ও তুরাগ এলাকায়। এফএইচবি, নিউ নাইন স্টার, বিগ বস, ম্যাড বয়েজ, ডিসকোসহ আরও কয়েকটি গ্রুপের উৎপাতে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ। সূত্র জানায়, শুধু উত্তরাতেই ১৫ থেকে ২০টি গ্রুপ সক্রিয়। প্রায়ই এরা দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। তাদের কোন্দলের জের খুনোখুনি পর্যন্ত গড়ায়। মারধর করা এদের নিত্যদিনের ঘটনা। উত্তরা গ্যাং পার্টির সঙ্গে টঙ্গী ও গাজীপুরের বখাটে কিশোররাও জড়িত। মোটরসাইকেল নিয়ে তারা প্রায়ই উত্তরায় এসে নানা অপকর্ম সেরে রাতে আবার টঙ্গী ও গাজীপুরে ফিরে যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালমা আক্তার বলেন, ‘গ্যাং পার্টির সদস্যদের মধ্যে এক ধরনের ‘হিরোইজম’ কাজ করে। যখন কোনো শিশু বা কিশোর ভদ্র আচরণ করে তখন আমরা মনে করি সে দুর্বল, আবার যখন কোনো শিশু বা কিশোর অভদ্র আচরণ করে তখন আমরা মনে করি তার মধ্যে হিরোইজম আছে। তাকে আরও উৎসাহ দিই। সেই অনুভূতিটি তাদের কিশোর বয়সেও কাজ করে। তা ছাড়া আমাদের সোশ্যাল ইনস্টিটিউটগুলো সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি ঠিকমতো পালন করছে না বলে কিশোররা গ্যাং কালচারের জড়িয়ে পড়ছে। কিশোরদের জন্য সঠিক সংশোধনের ব্যবস্থা করছি না, তাদের সামনে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কিংবা মানবিকতা শেখার কোনো ব্যবস্থা রাখছি না।’ একজন শিশু বা কিশোরের সুন্দরভাবে বড় হওয়ার জন্য তার ঘর বা পরিবার বিশেষ করে পিতা-মাতার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি বলে মনে করেন এই সমাজবিজ্ঞানী। র‌্যাবের তথ্যানুযায়ী, উত্তরার সক্রিয় গ্যাং গ্রুপ ‘এফএইচবি’র পুরো নাম ফার্স্ট হিটার বস। এটি তুফান গ্রুপ নামেও এলাকায় পরিচিত। এই গ্রুপে রয়েছে বিশুচন্দ্র শীল, নাঈম মিয়া, ইয়াসিন আরাফাত, আসিফ মাহমুদ, ফরহাদ হোসেন, আল আমিন হোসেন, বিজয়, শাওন হোসেন সিফাত, ইমামুল হাসান মুন্না, তানভীর হাওলাদার, আকাশ মিয়া, মেরাজুল ইসলাম জনি, হযরত আলী ও রাজীব। এরা নিজেদের দলের সদস্য সংখ্যা বাড়াতে ‘পিএসভি’ নামে একটি ড্যান্স একাডেমি খুলেছে। একই এলাকায় সক্রিয় আরেক গ্রুপ হলো ‘বিগ বস’। এর প্রধান আক্তারুজ্জামান ছোটন। উত্তরায় আরেক সক্রিয় ‘ডিসকো বয়েজ গ্রুপ’। এর দলনেতা শাহরিয়ার বিন সাত্তার সেতু।

 

 ২০১৬ সালে পেশায় হকার ছোটনের নেতৃত্বে ডিসকো বয়েজ গ্রুপের সহযোগী হিসেবে বিগ বস গ্রুপ তাদের কার্যক্রম শুরু করে। আবদুল্লাহপুর, বেড়িবাঁধ, কোটবাড়ী, ফায়দাবাদ এলাকায় তাদের আধিপত্য। এদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ‘নাইন স্টার’ গ্রুপের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এর নেতা রাজু একসময় তালাচাবি মেরামত করত। এই গ্রুপের প্রভাব রয়েছে উত্তরার ১২, ১৩, ১৪ নম্বর সেক্টর, খালপাড়, দিয়াবাড়ী ও বাউনিয়া বাঁধে। উত্তরায় সক্রিয় অন্য গ্রুপগুলোর মধ্যে রয়েছে কিংস অব উত্তরা, গ্যাং অব নিউ স্টার ফ্রম উত্তরা, দ্য কিং অব উত্তরা, ব্ল্যাক ওয়ার্ল্ড উত্তরা, দাদা বয়েজ উত্তরা অ্যান্ড অল টাইম কিং টপ ভাই-ব্রাদার, ঢাকার গ্যাংস্টার, উই আর ঢাকাইয়া গ্যাংস্টার, কাঁকড়া গ্রুপ, জি ইউনিট গ্রুপ, ব্ল্যাক রোজ, রনো গ্রুপ, কে নাইট গ্রুপ, ভাইপার গ্রুপ, ক্যাসল বয়েজ গ্রুপ, ঢাকার মাস্তান ও পাওয়ার বয়েজ উত্তরা। এ ছাড়া তুরাগে সক্রিয় ‘নিউ নাইন স্টার’ গ্যাং গ্রুপ। এলাকায় কোনো নতুন ভাড়াটিয়া এলে তাকে নানাভাবে ফাঁদে ফেলে চাঁদা দাবি করে এই গ্রুপের সদস্যরা। দক্ষিণখানেও রয়েছে গ্যাং পার্টির রাজত্ব। দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বে গত বছরের আগস্টে দক্ষিণখানে মেহেদী হাসান শুভ (১৭) নামে এক কিশোর খুন হয়। মিরপুর ও ভাসানটেকেও কয়েকটি গ্রুপ সক্রিয়। মোহাম্মদপুরে বছর দুয়েক ধরে চলছে ‘লাড়া দে’, ‘দেখে ল-চিনে ল’, ‘কোপাইয়া দে’ নামে গ্যাং গ্রুপের রাজত্ব। হাজারীবাগ ও পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায় দাপিয়ে বেড়ায় ‘বাংলা’ ও ‘লাভলেট’ নামে গ্যাং গ্রুপ। বরগুনায় আলোচিত নয়ন বন্ডের ‘০০৭’ গ্রুপের চেয়েও এরা ভয়ঙ্কর। রাজধানীজুড়ে এ রকম ৩০-৩২টি গ্যাং গ্রুপ রয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্যে, চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত কিশোর অপরাধের ঘটনায় ২০টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ৩১ জনকে গ্রেফতার করা হয়। যার মধ্যে ২৫ জনকে শিশু-কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। টঙ্গীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র সূত্র জানায়, সেখানে মোট ৭৫৫ জন শিশু-কিশোর রয়েছে। যারা খুন, মাদক বিক্রি, চুরি ও ছিনতাইয়ের মতো নানা অপরাধে জড়িয়েছিল। র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সরোয়ার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘গ্যাং কালচার মাথাচাড়া দেওয়ার আগেই আমরা ১৫-২০টি গ্রুপের সদস্যদের ধরেছি।

রাজধানীসহ দেশের সব এলাকায় বাড়তি নজরদারি রাখা হচ্ছে যেন তারা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে না পারে। গ্যাং গ্রুপের সদস্য হয়ে যারা বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে তাদের আমরা আইনের আওতায় আনছি। কিন্তু তাদের সংশোধনের মূল দায়িত্ব পরিবারের।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর