সোমবার, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে এনজিও

দুই বছরে নিজেদের দ্বন্দ্বে নিহত ৪৩, বন্দুকযুদ্ধে নিহত আরও ৩২

ফারুক তাহের, চট্টগ্রাম

রোহিঙ্গাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে এনজিও

মানবিক কারণে আশ্রয়প্রাপ্ত রোহিঙ্গারা দিন দিন বাংলাদেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রোহিঙ্গাদের একটি অংশ সব ধরনের অমানবিক ও অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বৈরী পরিবেশ সৃষ্টি করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আর তাদের এমন অপরাধমূলক কাজে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ইন্ধন দিয়ে যাচ্ছে দেশি-বিদেশি এনজিওগুলো। এনজিওগুলোই এখন রোহিঙ্গাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে। কোনো কোনো এনজিও নগদ অর্থ বিতরণ করে পরোক্ষে অস্ত্র সংগ্রহে রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে। এ অবস্থায় দেশের প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রয়েছে উদ্বিগ্ন। অতিসম্প্রতি খোদ দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনও আশঙ্কার সঙ্গে বলেছেন, সরকারের খুব ঘনিষ্ঠ একটি নন-গভর্নমেন্ট অরগাইনাইজেশন (এনজিও) রোহিঙ্গাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে। আরও নানা এনজিও প্রতিষ্ঠান এতে ইন্ধন দিচ্ছে। বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যারা রোহিঙ্গাদের এমন অনৈতিক কাজে সহযোগিতা করছে, সেই সব প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হবে।

৩০ আগস্ট শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতির পিতার শাহাদাতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে সিলেটে এক আলোচনা সভায় এমন অভিযোগ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি প্রশ্ন রাখেন, রোহিঙ্গাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। অথচ তারা কীভাবে এতগুলো সেলফোন ব্যবহার করছে? তার দাবি, রোহিঙ্গারা কেবল যে বাংলাদেশের সমস্যা তা নয়, এটা গোটা বিশ্বের সমস্যা। এ সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে কারও লাভ হবে না। সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

রোহিঙ্গাদের হাতে নগদ টাকা তুলে দেওয়ার বিষয়টি শুরুতে স্বাভাবিক ছিল। আর তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়ার বিষয়টি সবার নজরে আসে গত ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা নির্যাতনের দুই বছর পূর্তিকালে। ২৬ আগস্ট উখিয়ার কোটবাজার ভালুকিয়া সড়কে কামারের দোকানে বানানোর সময় রোহিঙ্গাদের সরবরাহের জন্য তৈরি করা ছয় শতাধিক দেশীয় অস্ত্র (ধারালো নিড়ানি) উদ্ধার করে প্রশাসন। এনজিও ব্যুরোকে অবগত না করে ‘মুক্তি কক্সবাজার’ নামের এক এনজিও গোপনে ওইসব অস্ত্র তৈরি করে তা রোহিঙ্গাদের মধ্যে সরবরাহের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাই ২৯ আগস্ট ‘মুক্তি কক্সবাজার’-এর ছয়টি প্রকল্পের সব ধরনের কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করে এনজিও ব্যুরো। এর বাইরে প্রশাসন ও এনজিও ব্যুরোর নজরদারিতে রয়েছে আরও ৪১টি এনজিও। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তাদের কার্যক্রমে অনেকটা নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে।  উল্লেখযোগ্য এনজিওগুলো হচ্ছেÑ ফ্রেন্ডশিপ, এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেলথ, আল মারকাতুল ইসলাম, স্মল কাইন্ডনেস বাংলাদেশ, আহমদিয়া মিশন, গ্রামীণ কল্যাণ, অগ্রযাত্রা, নেটওয়ার্ক ফর ইউনিভার্সাল সার্ভিসেস অ্যান্ড রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট, আল্লামা আবুল খায়ের ফাউন্ডেশন, ঘরনী, ইউনাইটেড সোশ্যাল অ্যাডভান্সমেন্ট, পালস, বুরো-বাংলাদেশ, এসএআর, আসিয়াব, এসিএলএবি, এসডব্লিউএবি, ন্যাকম, এফডিএসআর, জমজম বাংলাদেশ, আমান, ওব্যাট হেলপার্স, হেল্প কক্সবাজার, শাহবাগ জামেয়া মাদানিয়া কাসিমুল উলুম অরফানেজ, ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল অ্যান্ড হিউম্যান অ্যাফেয়ার্স, লিডারস, লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন, অ্যাসোসিয়েশন অব জোনাল অ্যাপ্রোচ ডেভেলপমেন্ট, হিউম্যান এইড অ্যান্ড রিলিফ অর্গানাইজেশন, বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিশ, হোপ ফাউন্ডেশন, ক্যাপ আনামুর, টেকনিক্যাল অ্যাসিস্টেন্স ইনকরপোরেশন, গরীব, এতিম ট্রাস্ট ফাউন্ডেশন প্রভৃতি। সরকারের এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর প্রধান কে এম আবদুস সালাম জানিয়েছেন, এসব এনজিওর কোনো কোনোটি তহবিল না পাওয়ার কারণে কাজ চালাতে পারছে না। আর নতুন করে যারা তহবিল পেয়ে আবেদন করছে, তাদের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। এদিকে দিন যত যাচ্ছে ততই অবনতির দিকে গড়াচ্ছে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩২টি রোহিঙ্গা শিবিরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। রোহিঙ্গাদের কাছে নগদ টাকা ও অস্ত্রশস্ত্র দিন দিন সহজলভ্য হয়ে ওঠায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। মানবতার দোহাই দিয়ে যাদের আশ্রয় দিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা, রোহিঙ্গারা এখন তাদের কাছে বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইয়াবা পাচার, ডাকাতি-চুরি ও হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে গত দুই বছরে চার শতাধিক মামলা হয়েছে। এসব মামলার আসামি এক হাজারের বেশি রোহিঙ্গা। এমন পরিস্থিতিতে পরবর্তী দিনগুলো নিয়ে শঙ্কিত স্থানীয় বাসিন্দারা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, গত দুই বছরে রোহিঙ্গা শিবিরে নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্বে নিহত হয়েছেন ৪৩ জন রোহিঙ্গা। এ ছাড়া ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আরও ৩২ রোহিঙ্গার নিহত হওয়ার কথা জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে প্রবেশের পর ডাকাতি, অপহরণ, ধর্ষণ, চুরি, মাদক ও মানব পাচারসহ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৪৭১টি। এর মধ্যে মাদক মামলা ২০৮, হত্যা মামলা ৪৩ ও নারী-সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ৩১টি। এসব মামলায় আসামি ১ হাজার ৮৮ রোহিঙ্গা। তাই এদের নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া আরও কঠিন হয়ে পড়বে বলে মনে করছে স্থানীয় সচেতন মহল। এদিকে আবারও রোহিঙ্গা শিবিরে অপতৎপরতা চালাতে বাংলাদেশে এসেছে সরকারের অনুমোদনহীন জার্মানির এনজিও ‘অ্যাকটিভ জোগেন’। বিতর্কিত এই এনজিওর কর্মকর্তারা রোহিঙ্গাদের মধ্যে নগদ টাকা বিতরণ করেন। অ্যাকটিভ জোগেনসহ বিভিন্ন এনজিওর দেওয়া নগদ টাকা কোনো কোনো রোহিঙ্গা সাগরপথে মালয়েশিয়ায় যেতে দালালদের হাতে তুলে দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ এসব টাকা দিয়ে দেশে তৈরি অস্ত্র সংগ্রহ করে ডাকাতি, মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপকর্ম করে যাচ্ছে। এ ছাড়া নামসর্বস্ব বিদেশি এনজিও রিভাত, ইলিকদার, স্থানীয় ডোল ইন্টারন্যাশনালসহ বেশ কয়েকটি এনজিও রোহিঙ্গা শিবিরে নগদ টাকা বিতরণ করে আসছে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে। যদিও রোহিঙ্গাদের মধ্যে নগদ টাকা বিতরণের কোনো নিয়ম নেই। অভিযোগ রয়েছে, এসব নামসর্বস্ব এনজিওর কতিপয় কর্মকর্তাকে রোহিঙ্গা শিবিরে নিয়ে আসে গাজীপুরের টঙ্গীর জামায়াতে ইসলামী পরিচালিত তা’মিরুল মিল্লাত মাদ্রাসার সাবেক অধ্যক্ষ ও দলটির রুকন শফিকুল্লাহ মাদানীর ছেলে তাওহিদ ও ডোল ইন্টারন্যাশনালের প্রধান সাইদুল ইসলাম রিজভী। কয়েক মাস আগে ডোল ইন্টারন্যাশনালের বিভিন্ন অপকর্ম গণমাধ্যমে উঠে এলে কিছুদিন গা ঢাকা দেন তাওহিদ ও সাইদ। সম্প্রতি আবারও ক্যাম্পে তারার নামে-বেনামে অপতৎপরতা শুরু করেছেন বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে। প্রশাসন ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ‘অ্যাকটিভ জোগেন’ নামে বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদনপ্রাপ্ত কোনো বিদেশি এনজিও নেই। এই নামে কোনো এনজিও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মকা- চালালে কঠোর ব্যবস্থা নেবে সরকার। বিষয়টি নিয়ে সতর্ক রয়েছে প্রশাসন। প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালে ২৪ আগস্ট রাতে রাখাইনের ৩০টি নিরাপত্তা-চৌকিতে একযোগে হামলার ঘটনা ঘটলে এর প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক নিপীড়ন শুরু করে। পরদিন ২৫ আগস্ট প্রাণ বাঁচাতে বানের স্রোতের মতো বাংলাদেশে প্রবেশ করতে থাকে রোহিঙ্গারা। বর্তমানে উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, উখিয়া-টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ৮৫ হাজার ৫৫৭ জন।

সর্বশেষ খবর