মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

শতভাগ বিদ্যুতে আলোকিত কেরানীগঞ্জ

মোস্তফা কাজল, কেরানীগঞ্জ থেকে ফিরে

শতভাগ বিদ্যুতে আলোকিত কেরানীগঞ্জ

শতভাগ বিদ্যুতের আলোয় বদলে গেছে রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠের জনপদ কেরানীগঞ্জ উপজেলা। এখানে চার-চারটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করায় এটি এখন আলো-ঝলমলে উপজেলা। মাত্র দেড় দশক আগেও সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে বেশির ভাগ গ্রামের ঘরে ঘরে জ্বলত সাঁঝবাতি। ঢাকার নিকটবর্তী হয়েও অধিকাংশ এলাকা ছিল বিদ্যুতায়নের বাইরে। কৃষকের জমির মাঝ বরাবর দেখা যেত বিদ্যুতের খুঁটির পর খুঁটি। রাজধানীর কাছাকাছি থেকেও এ জনপদের অধিবাসীদের ছিল নানা অভিযোগ আর আক্ষেপ। হাতে গোনা কয়েক জায়গায় বিদ্যুৎ ছিল। এতেও লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণা ভোগ করতেন গ্রাহকরা। ঢাকার অদূরে এ জনপদের চিত্র পুরোপুরি বদলে গেছে। এ উপজেলায় বিদ্যুতের চাহিদা ১৩০ কিলো মেগাওয়াট। কিন্তু উৎপাদন হয় ১৫০ কিলো মেগাওয়াট। ফলে উদ্বৃত্ত থাকে ২০ কিলো মেগাওয়াট।

সেই জনপদ আজ শতভাগ বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত। এ উপজেলার বাসিন্দারা জানেন না লোডশেডিং কী। শুধু খুঁটি নিয়ে আর তারা দিন কাটান না। গ্রাম ও ইউনিয়নে সীমাবদ্ধ নেই এ অঞ্চলের সংজ্ঞা। এলাকার বেশির ভাগ অংশ রূপ নিয়েছে নগরে। নগরায়ণ ও শিল্পায়নের ফলে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের আবাসস্থল হয়েছে এ লোকালয়। এখানকার মোট বিদ্যুৎ গ্রাহক ২ লাখ ৩৯ হাজার। গত কয়েক বছরে নতুন সংযোগ প্রদান করা হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার ২০০ জনকে। একসময় কৃষি এখানকার অধিকাংশ মানুষের প্রাণশক্তি থাকলেও বর্তমানে এ জনপদ হয়েছে কৃষি-শিল্প-বাণিজ্যের জনপদ। আধুনিক পরিচ্ছন্ন নগর ও পল্লীর অনন্য সংমিশ্রণে কেরানীগঞ্জকে এখন আর কেউ মফস্বল বলতে পারে না। আধুনিক সুযোগ-সুবিধায় রাজধানীর চেয়ে পিছিয়ে নেই কেরানীগঞ্জ। বিদ্যুতের আলোয় শুধু একটি জনপদ নয়। পরিবর্তিত হয়েছে এখানকার আর্থসামাজিক অবস্থাও। কেরানীগঞ্জ এলাকার নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের হাত ধরে এসেছে তৈরি পোশাকশিল্পের অগ্রগতি। কর্মসংস্থান হয়েছে হাজারো নারী-পুরুষের। স্থানীয় আগানগর-শুভাঢ্যা এলাকায় সুগম হয়েছে তৈরি পোশাকশিল্পের পথ। বর্তমানে আগানগর ও শুভাঢ্যা গার্মেন্টপল্লীতে ১০ হাজারেরও বেশি ক্ষুদ্র তৈরি পোশাক কারখানা দেশের অভ্যন্তরীণ পোশাকের প্রায় ৮০ ভাগ চাহিদা মেটাচ্ছে। কেরানীগঞ্জ গার্মেন্ট ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী মোহাম্মদ খোরশেদ আলম বলেন, এসব গার্মেন্টস মোকামে সব ধরনের পোশাক তৈরি ও বিক্রি হয় পাইকারি দরে। এখানকার পাঞ্জাবি ও জিন্স প্যান্টের মান ও বিক্রি সবচেয়ে বেশি। দেশের চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ পাঞ্জাবি ও জিন্স প্যান্টের চাহিদার জোগান দিয়ে থাকে এই গার্মেন্টস মার্কেট।

স্থানীয় গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা মনে করেন, শতভাগ বিদ্যুতের ফলে এ এলাকার গার্মেন্টশিল্প বিকশিত হয়েছে। তারা জানান, পুরো গার্মেন্টপল্লীতে ৩৭ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদার পুরোটাই সরবরাহ করা হচ্ছে। কেরানীগঞ্জ গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ও দোকান মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুল আজিজ বলেন, ‘আমরা চাহিদামতো গ্যাস, বিদ্যুৎ পাচ্ছি। এতে সময়মতো মালামাল সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ সরবরাহ খুব ভালো থাকায় জেনারেটর ব্যবহার করতে হচ্ছে না। এতে ব্যবসায়ীরা লাভবান হচ্ছেন বহুলাংশে। শতভাগ বিদ্যুতায়ন ও শিল্পের যে প্রসার ঘটেছে তা অবশ্য এক দিনে আসেনি। যুগোপযোগী পদক্ষেপ এ অঞ্চলের রূপ বদলে দিয়েছে। চাওয়ামাত্র এক দিনেই এ জনপদে মিলেছে নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস টেবিলে ফাইল জমে থাকার কোনো নজির নেই। বিসিক অঞ্চলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের পর্যাপ্ত প্রাপ্তি নিশ্চিত করা গেছে। শিল্প, অবকাঠামো ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হওয়ায় বাড়ছে অবকাঠামো। এসবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খুঁটির বদলে মাটির নিচ দিয়ে চলছে বৈদ্যুতিক লাইন স্থানান্তরের কাজ। শুধু কেরানীগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠন করা হয়েছে ঢাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-৪। উৎপাদিত বিদ্যুতের ওপর চাপ কমাতে নেওয়া হয়েছে বিকল্প ব্যবস্থা। রোহিতপুরে স্থাপন করা হয়েছে ২১ কিলোওয়াটসম্পন্ন সোলার চার্জিং সিস্টেম। নতুন সাবস্টেশন নির্মাণ ছাড়াও কেরানীগঞ্জের মতিয়ারা পাওয়ার প্লান্টকে ৫০ মেগাওয়াটে উন্নীত করা হয়েছে। নতুন প্রজন্ম আলোকিত হয়েছে বিদ্যুতের আলোয়। যে প্রজন্ম দেখবে না অন্ধকার। সেই অন্ধকারকে পেছনে ফেলে আলোর পথযাত্রী আধুনিক কেরানীগঞ্জের জনপদ।

সর্বশেষ খবর